বিশ্বকুরআনজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদসংবাদ বিশ্লেষণ

মাহদাভীয়াত দর্শনকে দেশ ও জাতির পরিসীমায় আবদ্ধ করা উচিত নয়

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সারসংক্ষেপ: আমাদের উচিত মাহদিভীয়তকে কোনো শিশুসুলভ ইচ্ছা বা নির্দিষ্ট জাতি ও অঞ্চলের সীমাবদ্ধ বিষয় হিসেবে দেখা নয়। এটি এক বৈশ্বিক দর্শন, এক গভীর দার্শনিক ধারণা, যা মানব সভ্যতার উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার পথে আল্লাহর দিকনির্দেশনায় একটি জীবনঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। যেভাবে একটি মানুষের জীবন শৈশব থেকে পরিপক্বতায় পৌঁছায়, তেমনি মানব সমাজও ধাপে ধাপে বুদ্ধি, ন্যায়, জ্ঞান ও মানবিকতার বিকাশের পথে এগিয়ে যায়। মাহদিভীয়ত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যে পরিপূর্ণতা কোনো স্বল্পমেয়াদি অর্জন নয়, বরং এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া—একটি অন্তর্দৃষ্টি, যা ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়কেই মানবতার প্রকৃত লক্ষ্য ও জীবনধারার সঙ্গে সংযুক্ত করে।

শহীদ আয়াতুল্লাহ মূর্তাজা মোতাহারী:  বক্তৃতায় “মাহদাভীয়াত ও বৈশ্বিক উন্নয়নের দর্শন” বিষয়টি উন্মোচন করেছেন, যা আমাদের চিন্তার গভীরে আলোকপাত করে। এই মূল্যবান বার্তা আমরা আপনাদের জন্য উপস্থাপন করছি।

আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে, হযরত হুজ্জাত (আ.)-এর বিষয়টি বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের মন ও বুদ্ধি সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে গঠিত হোক যা ইসলামের মূল তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটি কোনো সাধারণ বা স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষার বিষয় নয়; কোনো শিশুসুলভ ইচ্ছা বা প্রতিশোধমূলক আবেগের ফলাফলও নয়। আমাদের ধারণা যে ইমাম মাহদি (আ.) কেবল আল্লাহর অনুমতি পেলেই আসবেন এবং শুধুমাত্র ইরানি জাতি বা শিয়া সম্প্রদায়কে সুখী করবেন, তা সম্পূর্ণ ভুল। এই দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং সীমাবদ্ধ।

আমরা এমন একটি ঘটনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যা গভীর দর্শন ও বিস্তৃত আভিজাত্যের অধিকারী। ইসলামের প্রভাব শুধু আঞ্চলিক নয়, বরং এটি বিশ্বধর্ম, এবং শিয়াত্ব, তার প্রকৃত ও মৌলিক অর্থে, বিশ্বব্যাপী ধারণা।

অতএব, মাহদাভীয়াতকেও একটি বৃহৎ, বৈশ্বিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বোঝা প্রয়োজন। এটি শুধু ব্যক্তিগত বা আঞ্চলিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানব সভ্যতার সমগ্র উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

যখন কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَلَقَدْ کَتَبْنَا فِی الزَّبُورِ مِن بَعْدِ الذِّکْرِ أَنَّ ٱلْأَرْضَ یَرِثُهَا عِبَادِیَ ٱلصَّٰلِحُونَ,

এখানে ‘পৃথিবী’ বোঝানো হয়েছে—কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল, জাতি বা বর্ণ নয়। পুরো পৃথিবী লক্ষ্য করা হয়েছে, সীমিত ভৌগোলিক বা জাতীয় ধারণা নয়।

প্রথম মূল বিষয় হলো, পশ্চিমা বিশ্বের প্রচলিত কিছু ধারণার বিপরীতে, মানবজাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংসমুখী নয়। পশ্চিমা সভ্যতায় এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে, যেখানে আধুনিক মানুষ, সেই সভ্যতার মধ্যেই যা নিজেই তৈরি করেছে, মনে করে যেন তার জন্য নিজেই একটি কবর খনন করা হয়েছে। মনে হয়, মাত্র এক ধাপ দূরে বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এমন দৃশ্যমান পরিস্থিতি এই ধারণাকে শক্তিশালী করে, কিন্তু ধর্ম ও বিশ্বাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, মানবজাতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এবং প্রাণবন্ত।

মানব জীবনের প্রকৃত অর্থ ভবিষ্যতের মধ্যে নিহিত। যা আমরা বর্তমানে দেখছি, তা শুধুমাত্র প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিফলন। ভবিষ্যৎ হবে সেই যুগ যেখানে:

১. বুদ্ধি ও জ্ঞান রাজত্ব করবে,

২. ন্যায় ও সততা প্রতিষ্ঠিত হবে,

৩. মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতা শাসন করবে।

মানব জীবনের ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তিনটি প্রধান পর্যায়:

১- শৈশব ও কল্পনার যুগ – যেখানে শিশুর মন ভরপুর কল্পনা ও স্বপ্নে।

২- যৌবনকাল – আবেগ, রাগ ও কামনার প্রভাবে জীবন প্রভাবিত।

৩- বৃদ্ধাবস্থা – বুদ্ধি আবেগের উপর প্রাধান্য লাভ করে, পরিপূর্ণতা ও প্রজ্ঞার যুগ।

সমাজও একই ধারা অনুসরণ করে।

এখন প্রশ্ন: আমাদের যুগ, এই যুগের কেন্দ্রীয় চক্র কী? যদি গভীরভাবে দেখি, আমরা বুঝতে পারি, বর্তমান যুগ সংকট ও সংঘাতের, যেখানে আজকের জীবনের বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে বেশি বিরাজমান গন্ধ হলো বারুদ ও বিস্ফোরণ।

তবে ভবিষ্যৎ হবে সেই যুগ যেখানে জ্ঞান, ন্যায় ও মানবিকতা শাসন করবে।
কেননা আল্লাহ এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, মানুষকে সর্বোচ্চ সৃষ্টির মর্যাদা দিয়েছেন, এবং তাকে তার পূর্ণতা ও পরিপূর্ণতায় পৌঁছানোর সুযোগ দিয়েছেন। কল্পনা করা যায় কি, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্ট করেছেন কিন্তু তিনি কখনো তার পূর্ণতা অর্জন করেননি এবং হঠাৎ সবকিছু শেষ হয়ে যায়? এই ধারণা ঈশ্বরীয় বিচক্ষণতার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ।

অতএব, মাহদাভীয়াত হলো মানুষের পরিপক্বতা ও পূর্ণতার প্রতীক, এক ভাগ্যনির্ধারক মাইলফলক, যা প্রকৃত মানব জীবনের প্রতিষ্ঠা ও সার্থকতার দিক নির্দেশ করে। এটি শুধুমাত্র একটি দার্শনিক ভাবনা নয়, এটি আধ্যাত্মিক যাত্রার দিশারী, যা আমাদের মন ও হৃদয়কে আল্লাহর ন্যায় ও করুণার সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং মানব জাতিকে তার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা অর্জনের পথে অনুপ্রাণিত করে।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button