মানুষকে সৃষ্টি করার পর কেন আল্লাহ তার গুনাহের কারণে জাহান্নামের পথে নিক্ষেপ করেন?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: মানুষকে পতন ও শাস্তির জন্য সৃষ্টি করা হয়নি; বরং তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে পূর্ণতার ভোজে। জাহান্নাম কোনো পূর্বনির্ধারিত গন্তব্য নয়, বরং মানুষের নিজের ভুল নির্বাচন তাকে সেই পথে নিয়ে যায়। আল্লাহর উদ্দেশ্য সর্বদা কৃতিত্ব, শুদ্ধতা ও উন্নতি—আর প্রতিটি গুনাহই ফিরে আসার সুযোগ।
কেন আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করলেন?—এই প্রশ্ন তখনই অর্থবহ হয় যখন আমরা বুঝি যে সৃষ্টি নিজেই এক মহামূল্যবান উপহার, যার প্রকৃত মর্যাদা আমরা অনেকেই উপলব্ধি করি না।
কিছু মানুষ হতাশ হয়ে বলে: আমি তো সৃষ্টি হতে চাইনি! কেন আল্লাহ আমাকে বানালেন? কি এজন্য যে আমি গুনাহ করব আর শেষে জাহান্নামে যাব? কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়, এই ধারণা মূল থেকেই ভুল।
সৃষ্টির আগে আমি ছিলাম না
যে বলে আমি সৃষ্টি হতে চাইনি”, সে জানে না যে সৃষ্টির আগে তার কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
সঠিক প্রশ্ন হলো: এখন যেহেতু আমি সৃষ্টি হয়েছি, আমি কি সত্যিই অস্তিত্বকে ভালোবাসি? প্রত্যেক সৎ মানুষই বুঝবে—কেউই অস্তিত্বকে ঘৃণা করে না। আমরা সবাই জীবন, সৌন্দর্য, আনন্দ, ভালোবাসা, জ্ঞান, শক্তি ও পূর্ণতাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসা আমাদের অন্তরে প্রাকৃতিকভাবে স্থাপন করা হয়েছে।
অস্তিত্বের প্রতি প্রেম মানে স্রষ্টার প্রতি প্রেম
মানুষ সৌন্দর্য ও পূর্ণতাকে ভালোবাসে, কারণ এই প্রেম আল্লাহর প্রেমের প্রতিফলন। মানব সৃষ্টি আসলে আল্লাহর নামসমূহের প্রতিফলন, আর যে সত্তা আল্লাহর প্রতিফলন, সে ফিতরতের দিক থেকে তার উৎসের প্রতি প্রেমময়।
আল্লাহ বলেন:
إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ * فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ (সূরা হিজর, আয়াত ২৮–২৯)
বাংলা অর্থ: যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বললেন: আমি সৃষ্টি করব মানুষকে শুকনো মাটি থেকে, কালো কাদার আকারে। তারপর যখন তাকে সুসজ্জিত করব এবং আমার আত্মা তার মধ্যে ফুঁক দেব, তখন তোমরা তার সামনে সিজদায় পড়ে যেও।”
আল্লাহ মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেননি
এ ধারণা শয়তানের প্ররোচনা। সে নিজে জাহান্নামী হয়েছে এবং চায় মানুষও তার মতো হতাশ হোক। অথচ আল্লাহ বারবার ঘোষণা করেছেন, তাঁর উদ্দেশ্য শাস্তি নয়, বরং কৃতিত্ব ও উন্নতি।
আল্লাহ বলেন:
هُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ فِي الْأَرْضِ… (সূরা ফাতির, আয়াত ৩৯)
বাংলা অর্থ: তিনিই তোমাদের পৃথিবীতে উত্তরাধিকারী করেছেন…
গুনাহ শেষ নয়, ফিরে আসার শুরু
কুরআনের যুক্তি অনুযায়ী, গুনাহ মানেই জাহান্নাম নয়। বরং গুনাহে স্থির থাকা ও ফিরে না আসাই মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়।
আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ… (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৫)
বাংলা অর্থ: “যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করে, তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে…”
আরেকটি আয়াত হতাশার পর্দা ছিঁড়ে দেয়:
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ… (সূরা যুমার, আয়াত ৫৩)
বাংলা অর্থ: “বল: হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের প্রতি সীমালঙ্ঘন করেছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না…”
জাহান্নাম মানুষের নিজের নির্বাচন
আল্লাহ কাউকে বাধ্য করেননি। তিনি পথ খুলে দিয়েছেন এবং অসংখ্য ক্ষমার সুযোগ রেখেছেন।
আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ… (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩১)
বাংলা অর্থ: “বল: যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন…
কিন্তু যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর আয়াত ও সাক্ষাৎ অস্বীকার করে, তারা নিজেরাই হতাশার পথ বেছে নেয়:
وَالَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ اللَّهِ وَلِقَائِهِ أُولَئِكَ يَئِسُوا مِنْ رَحْمَتِي… (সূরা আনকাবুত, আয়াত ২৩)
বাংলা অর্থ: আর যারা আল্লাহর আয়াত ও তাঁর সাক্ষাৎ অস্বীকার করেছে, তারা আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়েছে…
ফলাফল
আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন “অস্তিত্ব”, “বিকাশ”, “সৌন্দর্য”, “পূর্ণতা” এবং “জান্নাত” এর জন্য। জাহান্নাম মানুষের গন্তব্য নয়; এটি তাদের পরিণতি যারা নিজেরাই আল্লাহর খোলা রহমতের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়।
শয়তান বলে: তুমি অবশ্যই জাহান্নামী হবে।কিন্তু আল্লাহ বলেন:
لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ “কখনোই আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।
অতএব, এই সন্দেহমূলক ধারণা মূল থেকেই ভ্রান্ত। আল্লাহ হলেন মূল্যবোধের স্রষ্টা, হতাশার নয়। আমরা এসেছি খলিফাতুল্লাহ হওয়ার মর্যাদায় পৌঁছাতে—জাহান্নামের জন্য নয়।



