বিশ্ব

“বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল”: গাজায় মানবিক সহায়তার পরিকল্পিত লুটপাটের প্রতীক

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: যুদ্ধবিরতির পর গাজার প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ যখন স্পষ্টভাবেই কমে এসেছে, তখন ইসরায়েলি শাসনব্যবস্থা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যেন গাজায় পাঠানো সীমিত মানবিক সহায়তাও প্রকৃত প্রয়োজনমতো মানুষের হাতে না পৌঁছায়।

মেহর নিউজ এজেন্সি আল-জাজিরার বরাতে জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন ৬০০টি ট্রাক খাদ্য, ওষুধ, তাঁবু, জ্বালানি ও অন্যান্য মৌলিক সামগ্রী নিয়ে গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি।

২৬ নভেম্বর ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত তথ্যে দাবি করা হয়, যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪,২০০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে, যার মধ্যে ৭০ শতাংশ ছিল খাদ্যবাহী। তেল আবিব আরও দাবি করে, যুদ্ধবিরতির পর থেকে ১৬ হাজারের বেশি খাদ্যবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে এবং প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার টন খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে।

তবে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় দেওয়া প্রতিশ্রুতির এক-চতুর্থাংশেরও কম বাস্তবায়ন করেছে।

আল-জাজিরা জানায়, খাদ্যবাহী ট্রাক গণনার পদ্ধতি নিয়েও গুরুতর সন্দেহ রয়েছে। কারণ অনুমতি পাওয়া বহু বাণিজ্যিক ট্রাক প্রকৃতপক্ষে কম পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য— যেমন চকোলেট ও বিস্কুট—অথবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল পণ্য বহন করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি কেজি হিমায়িত মুরগির দাম ২৫ ডলার এবং একটি ডিমের ট্রের দাম ৩০ ডলার পর্যন্ত।

মানবিক সংস্থাগুলো এমনকি এই সরকারি পরিসংখ্যান নিয়েও সন্তুষ্ট নয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতে, এই হিসাব সঠিক ধরলেও তা গাজার মোট খাদ্যচাহিদার মাত্র অর্ধেক পূরণ করে। ফিলিস্তিনি ত্রাণ সংস্থাগুলোর অনুমান, বাস্তবে মাত্র এক-চতুর্থাংশ সহায়তাই গাজায় প্রবেশ করতে পারছে।

অন্যদিকে, ইসরায়েল-সমর্থিত বিশৃঙ্খল সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতার কারণে এই সীমিত সহায়তারও খুব অল্প অংশ শেষ পর্যন্ত উদ্বাস্তু, দরিদ্র, আহত ও ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পৌঁছায়। অধিকাংশ সহায়তাই তথাকথিত “গাজার বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে” অদৃশ্য হয়ে যায়।

খাদ্য লুটকারী গোষ্ঠীগুলোকে ইসরায়েলের ইচ্ছাকৃত সহায়তা

চেকপয়েন্ট থেকে উদ্বাস্তু শিবির পর্যন্ত দূরত্ব মানচিত্রে খুব অল্প মনে হলেও বাস্তবে এটি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে সবচেয়ে বিপজ্জনক পথ। বহু ট্রাক এই স্বল্প দূরত্ব অতিক্রম করেও কখনোই সেই পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছায় না, যাদের এসব সহায়তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ট্রাক চলাচলের পথে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং প্রায়ই সেগুলোকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহার করতে বাধ্য করে। কিছু রাস্তা স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবার বা মহল্লা কমিটির সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া ব্যবহারযোগ্য নয়, আবার কিছু রাস্তা সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। ফলে কয়েক কিলোমিটারের যাত্রাই প্রাণঘাতী অভিযানে পরিণত হয় এবং বহু সহায়তা “গাজার বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে” হারিয়ে যায়।

আল-জাজিরা জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে নিখোঁজ সহায়তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে, বিশেষ করে যখন এসব খাদ্যসামগ্রী স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য দেখা গেছে—যেগুলোর গায়ে এখনো লেখা ছিল:“মানবিক সহায়তা – বিক্রয়ের জন্য নয়”

গাজায় সহায়তা নিখোঁজ হওয়ার মূল কারণ

প্রতিবেদনে বলা হয়, টানা দুই বছর ধরে চলমান পরিকল্পিত গণহত্যার ফলে গাজার শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে এবং এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে

জাতিসংঘের সহায়তা নজরদারি ব্যবস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯ মে থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ৮,০৩৫টি ট্রাক গাজায় নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছালেও ৭,১২৭টি ট্রাক লুটপাটের শিকার হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সহায়তা বহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অক্ষম। ঝুঁকির কারণে তারা ট্রাকের সঙ্গে যেতে বা সরাসরি খালাস কার্যক্রম তদারকি করতে পারে না। পাশাপাশি পর্যাপ্ত জনবলও তাদের হাতে নেই।

গাজায় খাদ্যবাহী ট্রাক লুটের প্রধান দায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ওপর বর্তায়। এর পাশাপাশি দ্রুত মুনাফার আশায় কিছু ব্যবসায়ী এবং অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীও এতে জড়িত। তবে এই পুরো প্রক্রিয়ার পেছনে রয়েছে ইসরায়েল ও তার মিত্ররা, যারা রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির অস্ত্র হিসেবে গাজার ক্ষুধাকে ব্যবহার করছে।

যুদ্ধবিরতির পর গাজার প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ হ্রাস

আল-জাজিরা প্রতিবেদনের উপসংহারে উল্লেখ করে, যুদ্ধবিরতির পর গাজার প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। বিশ্বজনমত এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করছে এবং মনে করছে গণহত্যা শেষ হয়ে গেছে। ফলে ক্ষুধার্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা আদৌ প্রবেশ করছে কি না—সে বিষয়ে আর প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না।

রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী মহলেও সহায়তা লুটকে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। এটি একটি পরিকল্পিত ও কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট সংকট, যা ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নতুন ধরনের সমষ্টিগত শাস্তি হিসেবে ব্যবহার করছে।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button