বাড়াবাড়ি ও অবহেলা থেকে পরিত্রাণের মূল চাবিকাঠি
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: নাহজুল বালাগা-এ ইমাম আলি (আ.) বলেন, অজ্ঞ ব্যক্তি সর্বদা অতিরিক্ত বা ঘাটতিপ্রবণ হয়ে থাকে। মধ্যপন্থা বা পরিমিত আচরণই সঠিক পথ, যা জীবন ও নৈতিকতার প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়।
ইমাম আলি (আ.) নাহজুল বালাগা-এর হিকমত ৭০-এ উল্লেখ করেছেন:
لَا [یُرَی الْجَاهِلُ] تَرَی الْجَاهِلَ إِلَّا مُفْرِطاً أَوْ مُفَرِّطاً.
সর্বদা অজ্ঞ ব্যক্তিকে তুমি বা অতিরিক্ত হতে দেখো বা ঘাটতিপ্রবণ হতে।
ইমাম আলি (আ.) এই বাক্যে মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেন, অজ্ঞ ব্যক্তি প্রায়শই পথভ্রষ্ট হয়: কখনও অতিরিক্ততা করে, কখনও ঘাটতি প্রয়োগ করে। সঠিক পথ হলো মধ্যপন্থা, যা মানুষের জীবনকে স্থির রাখে। আমাদের দৈনন্দিন নামাজে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদের এই সঠিক পথে রাখুন। পথের চারপাশে বিপথগামী লাইন রয়েছে, এবং সঠিক পথ চিহ্নিত করতে গভীর জ্ঞান ও সচেতনতার প্রয়োজন।
জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ততা ও ঘাটতির প্রভাব
পারিবারিক ও নৈতিক জীবন:
কিছু মানুষ অতিরিক্ত সচেতন হয়ে পরিবার বা স্ত্রীর প্রতি অতিমাত্রায় নজর রাখে, যা জীবনকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে। আবার কেউ সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যায়, যা সম্পর্ক ও নৈতিকতার ক্ষতি করে।
স্বাস্থ্য ও দৈনন্দিন জীবন:
কিছু মানুষ সবকিছু দূষিত মনে করে কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ করেন না, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলে, সবকিছু নিজে তৈরি করে। আবার কেউ ঘাটতি প্রদর্শন করে, যেখানে অমিশ্রিত ও দূষিত খাদ্য, রোগীর উপস্থিতি—সবই তার কাছে সমান হয়। শাস্ত্রজ্ঞরা বলেন, নৈতিক গুণাবলীতে মধ্যপন্থা সর্বদা দুই রকম অধঃপতিত গুণাবলীর মধ্যে অবস্থান করে। যেমন: সাহস হলো মধ্যপন্থা, যা অতিরিক্ত সাহসী (বেপরোয়া) ও দুর্বলতার মধ্যে থাকে। উদারতা হলো মধ্যপন্থা, যা কৃপণতা ও অপব্যয়ের মধ্যে অবস্থান করে। কোরআনে বলা হয়েছে:
وَلا تَجْعَلْ یَدَکَ مَغْلُولَةً إِلی عُنُقِکَ وَلا تَبْسُطْها کُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوماً مَحْسُوراً
“কখনও হাতকে ঘাড়ের সঙ্গে বাঁধো না এবং পুরোপুরি বিস্তার করো না যাতে তিরস্কৃত হও ও দুঃখে ভুগো।”
বিশ্বাস ও ধর্মীয় জীবনে মধ্যপন্থা:
ইমাম (আঃ) বলেন, যারা তার প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা দেখায় তারা প্রায়শই তাকে দেবতার সমতুল্য করে, আবার যারা কম গুরুত্ব দেয় তারা নাসিবানদের সঙ্গে অবস্থান করে। দুই পক্ষই ভুল। সঠিক পথ হলো ইমামের অবলম্বন ও আনুগত্য।
নাহজুল বালাগা, খুতবা ১২৭:
وَسَیَهْلِکُ فِیَّ صِنْفَانِ مُحِبٌّ مُفْرِطٌ یَذْهَب بِهِ الْحُبُّ إِلَی غَیْرِ الْحَقِّ وَمُبْغِضٌ مُفْرِطٌ یَذْهَب بِهِ الْبُغْضُ إِلَی غَیْرِ الْحَقِّ
দু’টি গোষ্ঠী আমার সম্পর্কে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে: এক, যে অতিরিক্ত প্রেম করে যা তাকে সত্যের বাইরে নিয়ে যায়; এবং দুই, যে অতিরিক্ত শত্রুতা করে যা তাকে সত্যের বাইরে নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন: «وَخَیْرُ النَّاسِ فِیَّ حَالاً النَّمَطُ الاَْوْسَطُ فَالْزَمُوهُ»
আমার সম্পর্কে সর্বোত্তম মানুষ হলো মধ্যপন্থীরা; তাদের থেকে বিচ্যুত হও না।”
বাহারুল আনওয়ার:
«أَلاَ إِنَّ خَیْرَ شِیعَتِی النَّمَطُ الاَْوْسَطُ إِلَیْهِمْ یَرْجِعُ الْغَالِی وَبِهِمْ یَلْحَقُ التَّالِی» আমার শ্রেষ্ঠ শিষ্যরা হলো মধ্যপন্থীরা; যারা অতিরিক্ততা করছে তাদেরকে তাদের দিকে ফিরতে হবে, আর যারা কম করছে তারা তাদের সাথে যুক্ত হবে।”
সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদাহরণ:
মানব সমাজের প্রধান সমস্যার উৎস হলো অতিপরিমিতি ও ঘাটতি, যা অজ্ঞতা থেকে জন্মায়। উদাহরণস্বরূপ:
১.অতিরিক্ত স্বাধীনতা প্রদান করলে নিষ্ঠুর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জন্মায়।
২.স্বাধীনতা হরণ করলে কমিউনিস্ট ব্যবস্থা ও তার জটিলতা দেখা দেয়।
সুতরাং মধ্যপন্থা খুঁজে পাওয়া এবং সেই পথে স্থির থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাদিসের উদাহরণ:
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিনে এমন একজন শাসককে আনা হবে যিনি আল্লাহর নির্দেশের চেয়েও বেশি করেছেন; আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, “তুমি কেন অতিরিক্ত তাড়িত করেছ?” তিনি বলবেন, “আমি আপনার রাগের কারণে কঠোর হয়েছিলাম।” আল্লাহ বলেন, “তোমার রাগ কি আমার রাগের চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয়?
অন্য একজন শাসককে আনা হবে, যিনি নির্দেশ অনুযায়ী কম কাজ করেছেন; আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, “কেন কম করেছ? তিনি বলেন, “আমি করুণা করেছি। আল্লাহ বলেন,তোমার করুণা কি আমার করুণার চেয়েও বেশি? এরপর দুইজনকেই দোজখের দিকে পাঠানো হবে।
পদটীকা:
(১) আল-ইসরা, আয়াত ২৯।
(২) বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৭৮, হাদিস ৭।
(৩) শরহ নাহজুল বালাগা, আল্লামা শোশত্রী, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ২৪৭।
(৪) হিকমতপূর্ণ বক্তব্যের উৎস: গুরুল হিকাম গ্রন্থে এই প্রাঞ্জল বাক্য সামান্য ভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
«الْجاهِلُ لَنْ یُلقی إلاّ مُفْرِطاً اَوْ مُفَرِّطاً»
এবং ইবনে আসির এটিকে নাহায়াহ গ্রন্থে আলি (আ.)-এর কাছ থেকে উদ্ধৃত করেছেন। (সোর্স: নাহজুল বালাগা, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫৬)।
সূত্র: কিতাবে পায়ামে ইমাম আমিরুল মুমিনিন (আ.), নাহজুল বালাগা-র উপর নতুন ও পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা



