ইতিহাসজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

বাকিয়াতুল্লাহ কে? ইমামে জামান (আ.ফা.) পৃথিবীতে আল্লাহর শেষ সংরক্ষিত নূরের উন্মোচন

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৩ ডিসেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: যখন পৃথিবীর বাতাসে অন্যায়ের ধোঁয়া ঘন হয়ে উঠবে, তখন একটি আলো ফুটবে—যে আলোর নাম “বাকিয়াতুল্লাহ”। তিনি আল্লাহর শেষ হুজ্জাত, নবুওয়তের শেষ উত্তরাধিকারী, পৃথিবীর বুকে আল্লাহর জীবন্ত স্মৃতিচিহ্ন। তাঁর আগমনের সঙ্গে মানুষ পাবে জ্ঞানের ২৭টি অংশের মধ্যে বাকি পঁচিশটি—যা আজ পর্যন্ত গোপন ছিল। আকাশের রহস্য, ফেরেশতার পথ, আত্মার গভীরতম স্তর—সবকিছু তাঁর নূরে উদ্ভাসিত হবে। তিনি আসবেন, আর পৃথিবী আবার জান্নাতের সুবাসে ভরে উঠবে।

কুরআনের ভাষায় তাঁর পরিচয়

সূরা হূদ, আয়াত ৮৬: ﴿بَقِيَّتُ اللَّهِ خَيْرٌ لَكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾

যা আল্লাহ তোমাদের জন্য রেখে দিয়েছেন, তা তোমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ—যদি তোমরা সত্যিকারের মুমিন হও।

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন, যখন কিয়ামতের আগে ইমাম মাহদী (আ.ফা.) প্রকাশ্যে আসবেন, মানুষ তাঁকে সালাম দেবে এই বলে—

 اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا بَقِيَّةَ اللَّهِ ‘শান্তি বর্ষিত হোক তোমার প্রতি, হে পৃথিবীতে আল্লাহর অবশিষ্ট নূর!’ অতঃপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করবেন।

জ্ঞানের সেই স্বর্ণযুগ

হুজ্জাতুল ইসলাম মাহদী ইউসুফিয়ান (মাহদাভীয়াত বিশেষজ্ঞ) বলেন, আজ পর্যন্ত মানুষ জ্ঞানের ২৭টি অংশের মাত্র ২টি পেয়েছে। বাকি ২৫টি ইমামে জামান (আ.জ.)-এর যুগেই প্রকাশিত হবে। মানুষ তখন আকাশের গোপন স্তর, মহাবিশ্বের রহস্য, আধ্যাত্মিক জগতের দরজা—সবকিছু নিজ চোখে দেখবে, নিজ হৃদয়ে উপলব্ধি করবে।

আল্লাহর নূর পূর্ণতা পাবে তাঁর হাতেই

কুরআন ঘোষণা করে:

﴿يُرِيدُونَ أَن يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ﴾

তারা মুখের ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূর নিভাতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরকে পূর্ণ করে দেবেন। (সূরা তাওবা ৩২, সূরা সাফ ৮)

এই পূর্ণতার নামই বাকিয়াতুল্লাহ। তিনি আসবেন, আর কুরআনের প্রতিটি আয়াত নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠবে।

﴿أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُم مَّا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ﴾

তুমি কি দেখ না, আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন? (সূরা লুকমান ২০)

আজ আমরা আকাশের একটি কোণও ঠিকমতো দেখতে পাই না। কিন্তু তাঁর যুগে মানুষ আকাশের সপ্তম স্তর পেরিয়ে ফেরেশতাদের পথে পা রাখবে। জ্ঞানের দরজা খুলে যাবে—যে দরজা হাজার বছর ধরে বন্ধ ছিল।

বাকিয়াতুল্লাহ” কী?

কুরআনের একটি শব্দ যা শুনলেই হৃদয় কেঁপে ওঠে

প্রশ্ন: বাকিয়াতুল্লাহ” শব্দটির অর্থ কী?

উত্তর: এটি কুরআনের একটি জীবন্ত আয়াতের অংশ—সূরা হূদ, আয়াত ৮৬। যখন হযরত শুয়াইব (আ.) তাঁর প্রতারক কওমকে সতর্ক করছিলেন, তিনি বলেছিলেন:

﴿بَقِيَّتُ اللَّهِ خَيْرٌ لَكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾

যা আল্লাহ তোমাদের জন্য রেখে দিয়েছেন, তা তোমাদের জন্য সর্বোত্তম—যদি তোমরা সত্যিকারের মুমিন হও।

তারা দাঁড়িপাল্লায় মাপে কম দিত, প্রতারণা করে সম্পদ বাড়াত। হযরত শুয়াইব (আ.) বললেন, অন্যায়ের মালে বরকত নেই। যদি তুমি সততার পথে চলো, হালালের পথে চলো, আল্লাহকে তোমার জীবনে ও ব্যবসায় শরীক করো—তবে আল্লাহ যা তোমার জন্য রেখে দেন, তাই দুনিয়া ও আখেরাতে তোমার জন্য সবচেয়ে উত্তম। সেই রেখে দেওয়া বরকতই হলো ‘বাকিয়াতুল্লাহ’।

এই শব্দটি শুধু অর্থনৈতিক নয়—এটি আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও অস্তিত্বগত। যা আল্লাহ মানুষের জন্য সংরক্ষিত রেখেছেন, তা-ই সর্বোত্তম।

কিন্তু এই শব্দটি কেন ইমামে জামান (আ.ফা.)-এর সবচেয়ে সুন্দর উপাধি হয়ে উঠল?

উসূলুলে কাফীতে ইমাম জা‘ফর সাদিক (আ.)-এর একটি হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা আছে। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, জাহের হওয়ার পর মানুষ ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-কে কীভাবে সালাম দেবে? ‘আসসালামু আলায়কা ইয়া আমীরুল মু’মিনীন’ বলবে?

ইমাম (আ.) বললেন, না। ‘আমীরুল মু’মিনীন’ উপাধি কেবল হযরত আলী (আ.)-এর জন্য। তাঁর (ইমাম মাহদী আ.ফা.) জন্য সালাম হবে:

اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا بَقِيَّةَ اللَّهِ

শান্তি বর্ষিত হোক তোমার প্রতি, হে পৃথিবীতে আল্লাহর অবশিষ্ট নূর!

অতঃপর ইমাম আয়াতটি পাঠ করলেন: ﴿بَقِيَّتُ اللَّهِ خَيْرٌ لَكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾

অর্থাৎ— তিনিই সেই মহামানব, যিনি আল্লাহর শেষ সংরক্ষিত রহমত। তিনিই সেই আলো, যাকে আল্লাহ পৃথিবীর শেষ যুগের জন্য রেখে দিয়েছেন। তিনিই সেই হুজ্জাত, যাঁর মাধ্যমে আল্লাহ বলবেন, আমি এখনো পৃথিবীকে পরিত্যাগ করিনি। আমার শেষ প্রমাণ, আমার শেষ দয়া, আমার শেষ নূর এখনো বেঁচে আছে।

শেষ কথা—তিনি আমাদের মাঝেই আছেন

“বাকিয়াতুল্লাহ” কোনো দূরের গল্প নন। তিনি আজও জীবিত। প্রতিটি নির্যাতিতের অশ্রুতে, প্রতিটি ন্যায়ের লড়াইয়ে তিনি হাসেন। যে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে, তার হৃদয়ে তিনি ইতিমধ্যে এসে গেছেন। আর যে ভুলে গেছে, তার জন্য তিনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কাবার পর্দার আড়ালে— শুধু একটি ডাকের অপেক্ষায়:

اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا بَقِيَّةَ اللَّهِ

শান্তি বর্ষিত হোক তোমার প্রতি, হে আল্লাহর অবশিষ্ট নূর!

তিনি আসবেন। আর যখন আসবেন, পৃথিবী শুধু বদলে যাবে না— পৃথিবী ফিরে পাবে তার হারিয়ে যাওয়া জান্নাতের চাবি।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button