ইতিহাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

প্রাচীন দর্শনে ওহীর ধারণা: একটি দার্শনিক পর্যালোচনা ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ওহী(ঐশী প্রত্যাদেশ) ধর্মীয় বিশ্বাসের একটি কেন্দ্রীয় ধারণা, বিশেষত আসমানি ধর্মসমূহে। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে দার্শনিকগণ এই ধারণাকে ধর্মতাত্ত্বিক নয়, বরং দার্শনিক কাঠামোর ভেতর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন দার্শনিকরা, বিশেষ করে গ্রিক দর্শনের প্রভাবে গড়ে ওঠা ইসলামি দর্শনের ধারায়, ওহীকে একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিশ্লেষণ করেন। এই প্রবন্ধে প্রাচীন দর্শনে ওহীর সংজ্ঞা, তার তাত্ত্বিক ভিত্তি এবং এ বিষয়ে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।

প্রাচীন দর্শনে ওহীর সংজ্ঞা

প্রাচীন দার্শনিকদের মতে, ওহী মূলত নবীর আত্মা (নফস)-এর সঙ্গে একটি বিশেষ বিমূর্ত সত্তা—যাকে তারা “সক্রিয় বুদ্ধি” (Active Intellect বা ‘আকল ফা‘‘আল’) নামে অভিহিত করেছেন—এর গভীর ও শক্তিশালী সংযোগ। এই সংযোগের ফলে নবী এমন জ্ঞান অর্জন করেন, যা সাধারণ মানুষ অর্জন করতে অক্ষম।

এই ব্যাখ্যায় ওহী কোনো আকস্মিক বাহ্যিক ঐশী হস্তক্ষেপ নয়; বরং এটি মানব আত্মার সর্বোচ্চ বিকাশের একটি ফল। সক্রিয় বুদ্ধিকে তারা সমস্ত জ্ঞান ও সত্যের ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচনা করেছেন, যা থেকে মানব আত্মা তার যোগ্যতা অনুযায়ী জ্ঞান গ্রহণ করে।

মানব আত্মার তিন শক্তি: দার্শনিক ভিত্তি

প্রাচীন দর্শনে মানব আত্মাকে তিনটি মৌলিক শক্তির সমষ্টি হিসেবে দেখা হয়—

১. সাধারণ ইন্দ্রিয় (হিস্‌সে মুশতারাক)

এই শক্তির মাধ্যমে মানুষ বাহ্যিক জগতের বস্তু ও রূপ উপলব্ধি করে। চোখ, কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য এখানে সমন্বিত হয়।

২. কল্পনাশক্তি (খেয়াল)

এই শক্তি মানুষকে বাহ্যিক জগতের অনুপস্থিত বস্তু বা ব্যক্তিকে মানসচক্ষে উপস্থিত করতে সক্ষম করে। এটি আংশিকভাবে বস্তুগত, আবার সম্পূর্ণ বিমূর্তও নয়।

৩. বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি (আকল)

এই শক্তির মাধ্যমে মানুষ সার্বজনীন ও বিমূর্ত ধারণা উপলব্ধি করে, যেমন—“মানুষত্ব”, “ন্যায়”, “সত্য” ইত্যাদি।

প্রাচীন দার্শনিকদের মতে, নবীর ক্ষেত্রে এই তিন শক্তিই চরম উৎকর্ষে পৌঁছে যায়।

সক্রিয় বুদ্ধি ও ওহীর প্রক্রিয়া

প্রাচীন দর্শন অনুযায়ী, সক্রিয় বুদ্ধি হলো এমন এক বিমূর্ত বুদ্ধিসত্তা, যা মানব আত্মাকে জ্ঞান দান করে। নবীর আত্মা যেহেতু অত্যন্ত শক্তিশালী ও পরিশীলিত, তাই তিনি খুব দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গভাবে সক্রিয় বুদ্ধির সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেন।

এই সংযোগের মাধ্যমে নবী প্রথমে সার্বজনীন ও বিমূর্ত সত্যগুলো উপলব্ধি করেন। এরপর তাঁর শক্তিশালী কল্পনাশক্তি সেই বিমূর্ত সত্যগুলোকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ দেয়। ফলে তিনি ফেরেশতার দর্শন করেন, শব্দ শুনতে পান এবং ওহির অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এই ব্যাখ্যায় ফেরেশতা ও শব্দ বাস্তব বাহ্যিক সত্তা নয়; বরং নবীর অভ্যন্তরীণ মানসিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন।

প্রাচীন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফল

এই তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রাচীন দার্শনিকরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হন—

১.ওহীর প্রকৃত বাহক হলো সক্রিয় বুদ্ধি।
২.ওহী ও সাধারণ জ্ঞানার্জনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই; পার্থক্য কেবল মাত্রাগত।
৩.নবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য গুণগত নয়, বরং ক্ষমতা ও পরিপক্বতার পার্থক্য।

সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

১. ধর্মতাত্ত্বিক আপত্তি

এই ব্যাখ্যায় ওহীকে একটি মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে নবুয়ত একটি ঐশী মনোনয়ন না হয়ে ব্যক্তিগত প্রতিভার চরম বিকাশে পরিণত হয়। অথচ আসমানি ধর্মসমূহে ওহীকে একটি স্বতন্ত্র ও অতিপ্রাকৃত ঐশী যোগাযোগ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

২. জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ভিত্তির দুর্বলতা

এই তত্ত্ব টলেমীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে নয়টি আকাশস্তর ও দশটি বুদ্ধির ধারণা রয়েছে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এই কাঠামো সম্পূর্ণভাবে বাতিল করেছে।

৩. মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা

কল্পনাশক্তির এমন ব্যাখ্যা—যেখানে কল্পনাকে বাস্তব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতায় রূপান্তর করা হয়—আধুনিক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সুস্থতার লক্ষণ নয়; বরং মানসিক বিভ্রান্তির লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

উপসংহার

প্রাচীন দার্শনিকদের ওহী-ব্যাখ্যা দর্শনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধিক প্রচেষ্টা হলেও, তা ধর্মতাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। এই ব্যাখ্যা ওহীকে ঐশী যোগাযোগের পরিবর্তে মানবীয় প্রতিভার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে চিহ্নিত করে, যা ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল ভিত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

তবে একথা অস্বীকার করা যায় না যে, প্রাচীন দর্শনের এই বিশ্লেষণ ওহী বিষয়ক আলোচনাকে নতুন বৌদ্ধিক মাত্রা দিয়েছে এবং দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

পাদটীকা

১.ফয়্যাজ লাহিজি, গওহর-এ মোরাদ, ভূমিকা: জয়নুল আবেদিন কোরবানি (তেহরান: নাশর-এ সায়েহ, ১৩৮৩ হি.শ.), পৃ. ৩৬৬।

২.ফয়্যাজ লাহিজি, গওহর-এ মোরাদ, অধ্যায় ৮, পৃ. ১৭৬; সদরুল মুতাআল্লিহিন শিরাজী (মোল্লা সদরা), আল-হিকমাতুল মুতাআলিয়া ফিল আসফারিল আকলিয়্যাহ আল-আরবাআহ (বৈরুত: দার ইহইয়াউত তুরাস, ১৯৮১), খণ্ড ৮, পৃ. ২০৫; মোল্লা হাদি সবজেওয়ারি, শরহে মানযুমা, সম্পা. ও টীকা: হাসানজাদে আমোলি, গবেষণা: মাসউদ তালেবি (তেহরান: নাশর-এ নাব, ১৩৭৯ হি.শ.), খণ্ড ১, পৃ. ৯৫।

৩.খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি (৫৯৮–৬৭২ হি.ক.), সপ্তম হিজরি শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক, গণিতবিদ ও ধর্মতত্ত্ববিদ।

৪.নাসিরুদ্দিন তুসি, তাজরিদুল ই‘তিকাদ, পর্যালোচনা: মুহাম্মদ জাওয়াদ হুসাইনি জালালি (তেহরান: মাকতাবুল ই‘লামিল ইসলামি, ১৪০৭ হি.ক.), পৃ. ১৫৫।

৫.কাতিব কাজভিনি, ঈযাহুল মাকাসিদ আন হিকমাতে আইনুল কাওয়ায়েদ, ব্যাখ্যা: আল্লামা হিল্লি।

৬.নাসের মাকারেম শিরাজী, রাহবারানে বোজর্গ (কোম: মাদরাসাতুল ইমাম আলি ইবনে আবি তালিব (আ.), ১৩৭৩ হি.শ.), পৃ. ১৬৬–১৭৫।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button