প্রতীক্ষার সীমা ছাড়িয়ে দায়িত্বের পথে—ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর আহ্বান
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: মুক্তির প্রতীক্ষা (انتظار فرج) নিছক একটি দোয়া নয়; এটি আসলে এক সক্রিয়, গতিশীল ও দায়িত্বশীল জীবনধারা। একজন মুমিনের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস, প্রতিটি আমল যেন ইমাম মাহদী (আ.)–এর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে সাজানো থাকে। নামাজ, আনুগত্য, দোয়া ও ইস্তেগফার হয়ে ওঠে সেই জীবনধারার স্তম্ভ, আর বেলায়াত ও হৃদয়ের বিশ্বাস তাকে মাহদাভী জীবনের পূর্ণতায় পৌঁছে দেয়।
নামাজ: মাহদাভী জীবনের কেন্দ্রবিন্দু
ইমাম মাহদী (আ.)–এর হাদিসে নামাজকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন: নামাজের মতো কোনো আমল শয়তানের নাককে এতটা অপমানিত করে না; নামাজই তাকে প্রকৃত অর্থে পরাভূত করে।
আবার ফজরের নামাজ সম্পর্কে তাঁর কঠোর সতর্কবাণী:
ধিক্ এবং অভিশপ্ত সেই ব্যক্তি, যে ইচ্ছাকৃতভাবে ফজরের নামাজ এত বিলম্ব করে যে আকাশ থেকে তারা হারিয়ে যায়।
এ থেকে স্পষ্ট হয়—ইমামের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অপরিহার্য হলো সময়মতো নামাজ আদায়, বিলম্ব এড়িয়ে চলা এবং গাফিলতি থেকে বিরত থাকা। নামাজ-পরবর্তী দোয়া, তাসবিহ ও তাআকিবাতও মাহদাভী জীবনধারার অপরিহার্য অংশ।
বেলায়াত ও হৃদয়ের বিশ্বাস
ইমাম মাহদী (আ.) এবং অন্যান্য ইমামগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ ওলী, কর্মজগতের কেন্দ্রবিন্দু এবং ঐশী ফায়েজের মাধ্যম। তাঁদের প্রতি বিশ্বাস রাখা প্রতিটি শিয়া মুসলমানের ধর্মীয় দায়িত্ব।
ইমাম মাহদী (আ.) বলেছেন: আমরা আহলে বাইত, সমস্ত বিষয়ে কেন্দ্র ও অক্ষ; আমরা হেদায়েতের ইমাম, পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা।
এই বিশ্বাস শুধু ইমামের হৃদয়কে আনন্দিত করে না, বরং মুমিনের জীবনকে নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার পথে পরিচালিত করে।
ইমামের সন্তুষ্টি অর্জন
ইমামের সন্তুষ্টি অর্জন কোনো জটিল সমীকরণ নয়। যে ব্যক্তি এমন কাজ করে যা তাঁকে আনন্দিত করে, এবং বিরত থাকে যা তাঁকে অসন্তুষ্ট করে—সে আসলে মাহদাভী জীবনধারা অনুসরণ করছে।
ইমাম মাহদী (আ.) বলেছেন: তোমাদের প্রত্যেকে এমন কাজ করবে যা আমাদের কাছে আসার ও আমাদের ভালোবাসা অর্জনের কারণ হয়; আর যেসব কাজ আমাদের জন্য অপছন্দনীয় ও ক্রোধের উদ্রেককারী—তা থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে।
তাঁর সতর্কবাণী হলো—তওবা বিলম্ব করলে তা আর কাজে আসবে না। তাই যতক্ষণ সময় আছে, ঈমান, আনুগত্য ও পরহেজগারির জীবন শুরু করা জরুরি।
জুহুরের জন্য দোয়া
ইমাম মাহদী (আ.)–এর জুহুরের জন্য দোয়া করা প্রতিটি মুমিনের স্থায়ী দায়িত্ব। তিনি ইসহাক ইবনে ইয়াকুবকে লিখিত চিঠিতে নির্দেশ দেন:
জুহুর ত্বরান্বিত হওয়ার জন্য তোমরা প্রচুর দোয়া করবে—প্রতিটি উপযুক্ত সময়ে।
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) বলেছেন:
এই কঠিন পরিস্থিতিতে কেউ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে না—যদি না আল্লাহ তাকে জুহুরের জন্য দোয়া করার তাওফিক দেন।
অতএব, ইমামের স্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু এবং জুহুরের ত্বরান্বিত হওয়ার জন্য দোয়া করা প্রতিটি মুমিনের জীবনের অপরিহার্য অংশ।
অন্যের সীমানা ও সম্মান রক্ষা
ইমাম মাহদী (আ.)–এর বাণীগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো—অন্যের সীমানা, সম্পত্তি বা ব্যক্তিগত বিষয়ে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা নিষিদ্ধ।
তিনি বলেছেন: কেউ অন্যের সম্পদ বা বিষয়াবলিতে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না—যদি না সে মালিকের অনুমতি লাভ করে।
এটি ইসলামের মৌলিক নৈতিক নির্দেশনার অন্যতম। যে ব্যক্তি অন্যের হক লঙ্ঘন করে না, অনুমতি ছাড়া তার সীমানায় প্রবেশ করে না—সে ইমামের সন্তুষ্টি অর্জনের পথে অগ্রসর হয়।
এভাবেই মুক্তির প্রতীক্ষা একজন মুমিনকে মাহদাভী জীবনধারায় রূপান্তরিত করে—যেখানে নামাজ, বেলায়াত, দোয়া ও নৈতিকতা মিলিত হয়ে ইমাম মাহদী (আ.)–এর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ উন্মুক্ত করে।
উপসংহার
এভাবেই মাহদাভী জীবনধারা একজন মুমিনকে আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতায় পৌঁছে দেয়। নামাজে দৃঢ়তা, বেলায়াতে বিশ্বাস, দোয়ায় আন্তরিকতা এবং নৈতিকতায় অবিচলতা—এসবের সমন্বয়েই ইমাম মাহদী (আ.)–এর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হয়। মুক্তির প্রতীক্ষা তাই নিস্ক্রিয় বসে থাকা নয়; বরং সক্রিয় ঈমানি জীবনযাপন, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করে।



