জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

পারিবারিক সচেতনতা | আমার দুই বছরের সন্তান মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে; কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করব?

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: একজন অভিভাবক প্রশ্ন তুলেছেন— “আমার দুই বছর তিন মাস বয়সী সন্তান মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এর কারণ কী, এবং এ পরিস্থিতি সামলানোর বৈজ্ঞানিক উপায় কী?”

এর জবাবে পারিবারিক পরামর্শক ও বিশেষজ্ঞ হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ আলি রেজা তারাশিওন বলেছেন, দুই বছরের শিশুর মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ মূলত অভিভাবক ও আশপাশের পরিবেশের অনুকরণ থেকে সৃষ্টি হয়। কারণ শিশুরা বিশ্লেষণ না করে কেবল অনুকরণ করে — তারা যা দেখে, তাই করে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, “যখন শিশু দেখে যে মা সারাক্ষণ মোবাইল ফোনে ব্যস্ত, বাবা ফোনে নিমগ্ন, বড় ভাই ফোনে কাজ করছে, এমনকি আত্মীয়স্বজন বা অতিথিরাও কথা বলার বদলে ফোনে তাকিয়ে আছে— তখন শিশুর কাছেও এই আচরণ ‘স্বাভাবিক’ মনে হয়। ফলে সে-ও একই অভ্যাস গড়ে তোলে।”

প্রথম ধাপ: অভিভাবকের আত্মসমালোচনা

তারাশিওনের মতে, সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হলো অভিভাবকের নিজের আচরণ পুনর্বিবেচনা করা। কারণ শিশু মূলত আমাদের আচার–আচরণকেই প্রতিফলিত করে।

তিনি অভিভাবকদের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন:

১. মোবাইল ব্যবহারের নিষিদ্ধ স্থান নির্ধারণ করুন

পরিবারে স্পষ্টভাবে ঠিক করতে হবে, কোথায় এবং কোন সময়ে মোবাইল ব্যবহার করা যাবে না।
উদাহরণস্বরূপ:

  • খাবার টেবিলে ফোন ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ থাকা উচিত।

  • কল্পনা করুন, কেউ এক হাতে চামচ ধরে খাচ্ছে আর অন্য হাতে ফোনে ব্যস্ত— এই দৃশ্য শিশুকে শেখায়, এটাই স্বাভাবিক আচরণ।

  • তেমনি ঘুমের ঘর, পারিবারিক সময় বা সন্তানের সঙ্গে খেলার সময় ফোন ব্যবহার না করার নিয়ম রাখতে হবে।

২. নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন

যদি কখনও ফোন ব্যবহার করতেই হয়, তবে সেটি আগে থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করতে হবে। যেমন— বাবা-মা দিনের নির্দিষ্ট এক সময় (যখন সন্তান ঘুমাচ্ছে বা খেলছে) ফোন ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু শিশুর সামনে নয়।

এর পাশাপাশি, ঘরে ফোনকে এমনভাবে রাখুন যাতে তা শিশুর চোখে সহজে না পড়ে।
কিছু পরিবার এমন একটি সৃজনশীল পদ্ধতি অবলম্বন করেছে— তারা একটি বিশেষ বাক্স বা ড্রয়ারে ফোনগুলো রেখে দেয়, যাতে ঘরে ঢোকার পর আর কেউ ফোন হাতে না রাখে। এতে ঘরের পরিবেশ শান্ত থাকে, এবং শিশুরাও সঠিক আচরণের অনুকরণ শেখে।

পারিবারিক অগ্রাধিকার: সম্পর্ক, না ফোন?

হুজ্জাতুল ইসলাম তারাশিওন বলেন, “পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কই হওয়া উচিত প্রথম অগ্রাধিকার— ফোন নয়।”

আজকাল অনেকেই সামনাসামনি কথা বলার সময় ফোন বেজে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে কথোপকথন বন্ধ করে ফোন ধরেন। এই অভ্যাস, তার মতে, একধরনের অসম্মান।

তিনি বলেন, “যদি ফোনের বিষয়টি সত্যিই জরুরি হয়, মানুষ আবার ফোন করবে। কিন্তু যদি আমরা সন্তান বা জীবনসঙ্গীর সঙ্গে কথা বলার মাঝখানে ফোন ধরি, তখন শিশুর মনে অজান্তেই এ বার্তা যায়— ‘ফোন আমার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

এভাবে শিশু ধীরে ধীরে নিজেকে দ্বিতীয় স্থানে দেখে এবং ভবিষ্যতে সেই একই আচরণ পুনরাবৃত্তি করে— অর্থাৎ, সম্পর্কের চেয়ে যন্ত্রকে অগ্রাধিকার দেয়।

 শিশুর শেখা নির্ভর করে অভিভাবকের আচরণের ওপর

তারাশিওন জোর দিয়ে বলেন,  “শিশুরা বিশ্লেষণ করে না, শুধু দেখে এবং অনুকরণ করে। তাই তাদের সঠিকভাবে শেখাতে চাইলে আমাদেরকেই প্রথমে নিজেদের আচরণ পরিবর্তন করতে হবে।”

অভিভাবকরা যদি ফোন ব্যবহারে শৃঙ্খলা আনেন, তবে শিশুরাও সেই শৃঙ্খলার অনুকরণ করবে। আর যদি বাড়ির পরিবেশে সবসময় ফোনই মুখ্য ভূমিকা নেয়, তবে শিশুরাও তেমনই হয়ে উঠবে। অতএব, সন্তানের ফোন–আসক্তি নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি হলো অভিভাবকের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button