পারিবারিক শিক্ষা | শিশুর মোবাইল আসক্তি কাটানোর কার্যকর উপায়
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

পারিবারিক শিক্ষা | শিশুর মোবাইল আসক্তি কাটানোর কার্যকর উপায়
মিডিয়া মিহির: আজকের যুগে মোবাইল ফোন যেমন যোগাযোগ ও তথ্যের অপরিহার্য মাধ্যম, তেমনি শিশুদের জন্য এটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জও হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে দুই থেকে তিন বছর বয়সী শিশুরা অত্যন্ত অনুকরণপ্রবণ; তারা যা দেখে তাই নকল করে। তাই মোবাইল আসক্তি প্রতিরোধের জন্য প্রথমেই বাবা-মাকে নিজেরাই সঠিক উদাহরণ তৈরি করতে হবে।
শিশুর মোবাইল নির্ভরতা কমাতে হলে—
> পরিবারের ভেতরে মোবাইল ব্যবহারের সঠিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে,
> নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে এর ব্যবহার সীমিত করতে হবে,
> এবং শিশুকে মুখোমুখি যোগাযোগ ও সম্পর্কের গুরুত্ব শেখাতে হবে।
এ বিষয়ে পরিবার ও বিয়ে-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ আলী রেজা তারাশিয়ুন প্রশ্নোত্তর আকারে কয়েকটি কার্যকর পরামর্শ দিয়েছেন।
শিশু কেন এত দ্রুত অভ্যাসে বাঁধা পড়ে?
এই বয়সে শিশুদের চিন্তাশক্তি পুরোপুরি বিশ্লেষণী হয় না। তারা মূলত “তোতাপাখির মতো” অনুকরণ করে।
যদি তারা দেখে—
> মা সবসময় ফোনে ব্যস্ত,
> বাবা মোবাইলে ডুবে আছেন,
> কিংবা বড় ভাইবোনেরা পরিবার বা সামাজিক অনুষ্ঠানে ফোনে সময় কাটাচ্ছে— তাহলে শিশুর পক্ষেও একই কাজ করা একেবারেই স্বাভাবিক। তাই শিশুর অভ্যাস পরিবর্তনের প্রথম ধাপ হলো বাবা-মায়ের নিজের আচরণ পরিবর্তন।
মোবাইল ব্যবহারে দুটি মূলনীতি
১. নিষিদ্ধ এলাকা নির্ধারণ: বাড়ির কিছু জায়গা ও সময় ঠিক করে নিতে হবে যেখানে মোবাইল ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ থাকবে। যেমন— খাওয়ার টেবিলে, শোবার ঘরে, বা পারিবারিক আড্ডার সময়। যদি বাবা-মা এমন পরিস্থিতিতে ফোন ব্যবহার করেন, শিশু তা অবচেতনভাবে শিখে নেবে।
২. সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা: শিশুর সামনে মোবাইল ব্যবহার না করাই উত্তম। যদি আধঘণ্টা ফোন ব্যবহার করতেই হয়, তবে শিশুর ঘুমের সময় বা খেলাধুলার সময় তা করা ভালো। শিশুর সামনে এ কাজ করলে সে সঙ্গে সঙ্গেই আচরণটি অনুসরণ করবে।
একটি সফল উদাহরণ হলো— এক পরিবার ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে একটি নির্দিষ্ট বাক্সে ফোন জমা দেয়ার নিয়ম পালনে বাধ্য করেছিল। ফলে ফোন আর ঘরের মূল পরিবেশে প্রবেশ করতে পারত না এবং পরিবারে প্রশান্তি ফিরে আসে।
সঠিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা
ফোন ব্যবহারের সময় পারস্পরিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মা সন্তান বা সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলার মাঝেই ফোন বেজে উঠলে কথোপকথন থামিয়ে দেন। এটি আসলে এক ধরনের “যোগাযোগে অসম্মান”। কারণ এতে সামনের ব্যক্তি অনুভব করে যে তার গুরুত্ব ফোনের চেয়ে কম। যদি কল জরুরি হয়, আবারও আসবে। না হলে পরে উত্তর দেওয়া যায়। সর্বদা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত সেই ব্যক্তিকে, যিনি আমাদের সামনে উপস্থিত আছেন—হোক তিনি সন্তান, স্ত্রী বা অন্য কেউ।
শিশুর মানসিকতায় প্রভাব
ধরা যাক, সন্তান প্রশ্ন করতে এসেছে, কিন্তু বাবা-মা হঠাৎ ফোন ধরলেন। এতে শিশুর মনে স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে যায়: “ফোন আমার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” ফলে ভবিষ্যতে তার কাছে মোবাইলই হবে প্রধান অগ্রাধিকার, বাবা-মা নয়। তাই মনে রাখতে হবে, শিশুরা বিশ্লেষণ করে না; তারা শুধু দেখে এবং অনুকরণ করে। যদি বাবা-মা সঠিক আচরণ প্রদর্শন করেন, শিশুরাও ধীরে ধীরে একই আচরণকে অভ্যাসে পরিণত করবে।
অতিরিক্ত কিছু পরামর্শ
শিশুর সামনে ফোনের ব্যবহার কমিয়ে দিন এবং বিকল্প হিসেবে খেলনা, গল্প বা সৃজনশীল কাজে তাকে যুক্ত করুন। মোবাইলকে শিশুর পুরস্কার বা শাস্তির মাধ্যম বানাবেন না। এতে তার গুরুত্ব শিশুর চোখে আরও বেড়ে যাবে। শিশুর সঙ্গে বেশি সময় কাটান, তাকে প্রশ্ন করুন, কথা বলুন, হাঁটতে নিয়ে যান—এই সম্পর্কই তার জন্য ফোনের বিকল্প হয়ে দাঁড়াবে।
সারকথা: শিশুদের মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্ত করতে হলে প্রথমেই বাবা-মাকে নিজেদের অভ্যাস ও আচরণ সংশোধন করতে হবে। শিশুরা “শোনে না, দেখে শেখে।” তাই বাবা-মায়ের সঠিক উদাহরণই হবে তাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর শিক্ষা।