পারমাণবিক স্থাপনাগুলো আমরা আরও শক্তি ও দৃঢ়তার সঙ্গে পুনর্নির্মাণ করব: পেজেশকিয়ান
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ২রা নভেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইরানের রাষ্ট্রপতি ড. মাসউদ পেজেশকিয়ান শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শিল্পের উন্নয়নে সরকারের পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, “সরকার সর্বশক্তি দিয়ে এই শিল্পের অগ্রগতি ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে পাশে থাকবে।”
রাষ্ট্রপতির সফর ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বৈঠক
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা মেহর-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি পেজেশকিয়ান ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থায় উপস্থিত হয়ে স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও রেডিও-ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরানি বিজ্ঞানীদের সর্বশেষ উদ্ভাবনী অর্জনের প্রদর্শনী পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে তিনি পারমাণবিক শিল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক আন্তরিক ও সরাসরি আলোচনায় অংশ নেন।
রাষ্ট্রপতি বৈঠকে ১২ দিনের যুদ্ধের শহীদদের, বিশেষ করে দেশের পারমাণবিক শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, “আমাদের বিজ্ঞানীরা রেডিও-ওষুধ উৎপাদন ও আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির উন্নয়নে যে নিরলস পরিশ্রম করছেন, তা এক অনন্য বৈজ্ঞানিক জিহাদ এবং জাতির প্রতি নিঃস্বার্থ সেবা। এই প্রচেষ্টা দেশের এক মৌলিক প্রয়োজন, যা আরও দ্রুততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে।”
আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ অপরিহার্য
পেজেশকিয়ান বলেন, ইরান বর্তমানে রেডিও-ওষুধ উৎপাদনে অনন্য অবস্থান অর্জন করেছে। এই প্রযুক্তি জাতীয় সম্পদ সৃষ্টিতে এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এখন জাতির জন্য একান্ত প্রয়োজন।”
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, “আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো চায় স্বাধীন দেশগুলো—বিশেষ করে ইরান—উন্নত প্রযুক্তিতে প্রবেশ করতে না পারে। তারা চায় আমরা নির্ভরশীল থাকি, যাতে তারা নিজেরা উৎপাদন করে, ওষুধ তৈরি করে, তারপর সেগুলো আমাদের মতো দেশগুলোর কাছে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করতে পারে।”
তিনি বলেন, “বর্তমান কার্যক্রমগুলো অত্যন্ত মূল্যবান, কিন্তু এর পাশাপাশি আমাদের রপ্তানি ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের দিকেও মনোযোগী হতে হবে। শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ যথেষ্ট নয়। আমাদের পণ্যগুলোর গুণমান, কার্যকারিতা ও ন্যায্য মূল্যই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের অগ্রগামী অবস্থান নিশ্চিত করবে।”
শত্রুদের উদ্বেগ: “আমাদের বিজ্ঞানীরা সক্ষম, তাই তারা আতঙ্কিত”
রাষ্ট্রপতি পেজেশকিয়ান বলেন, “ইরানের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা নিয়েই বড় শক্তিগুলোর আতঙ্ক। তারা বারবার মিথ্যা অভিযোগ তোলে যে আমরা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছি, অথচ তারা জানে—আমাদের কর্মসূচিতে অস্ত্র তৈরির কোনো স্থান নেই। তবুও তারা এই মিথ্যা অভিযোগকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের অগ্রগতি রোধের চেষ্টা করছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের তরুণ ও প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা দেশের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট সক্ষম। তারা নিশ্চুপ বসে থাকবে না, বরং নিজেদের মেধা ও দক্ষতাকে জাতীয় প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত করে কাজ করছে। তারা প্রমাণ করেছে, ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিগত চাহিদা পূরণ করতে পারে।”
রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা আমাদের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক অর্জনগুলো বিশ্ববাসীর সামনে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। শত্রুদের মিথ্যা প্রচারণা মোকাবেলায় কার্যকর প্রচার ও বাজারজাতকরণ কাঠামো গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।”
জ্বালানি অপচয় ও বিজ্ঞানীদের ভূমিকা
পেজেশকিয়ান জ্বালানি অপচয় এবং পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়েও কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “আমরা প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ব্যারেল তেল ও গ্যাস জ্বালিয়ে ফেলি। এর ফলে শুধু পরিবেশ দূষিত হয় না, বরং আমরা বিপুল মূল্যবান সম্পদ নষ্ট করি। আমাদের উচিত এই সম্পদগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে কাজে লাগিয়ে মূল্য সংযোজন করা। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দায়িত্ব আমাদের বিজ্ঞানী ও মেধাবীদের কাঁধে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “শত্রুরা আমাদের বিজ্ঞানীদের ভয় পায়, কারণ তারা জানে—আমাদের বিজ্ঞানীরা এমন সক্ষমতা রাখেন যা তাদের বাজারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এই কারণেই তারা আমাদের বিজ্ঞানীদের টার্গেট করে, কারণ এই জ্ঞানই আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতার ভিত্তি।”
বিশ্ববিদ্যালয় ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি
রাষ্ট্রপতি বলেন, “চতুর্থ প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা, আন্তঃবিষয়ক সহযোগিতা এবং সমস্যা সমাধানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। আমাদের পারমাণবিক শিল্পের বিজ্ঞানীদেরও উচিত নিজেদের জ্ঞান ও সক্ষমতাকে পানি, কৃষি ও পরিবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগানো।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কী উৎপাদন করব, কিভাবে করব, কোন মানে এবং কোথায় তা বিতরণ করব—এই সিদ্ধান্তগুলো আমাদের নিজেদের নিতে হবে। আমাদের মেধাবীরাই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবচেয়ে বড় সহায় হতে পারেন।”
রাষ্ট্রপতি আফসোস করে বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শত্রুরা এমনভাবে প্রচারণা চালিয়েছে যে সাধারণ মানুষের মনে ‘পারমাণবিক’ শব্দটি শুনলেই অস্ত্রের ধারণা জন্মায়। অথচ বাস্তবে, পারমাণবিক শিল্প একটি বিশাল বৈজ্ঞানিক ও শিল্পভিত্তিক ক্ষেত্র—যার অতি ক্ষুদ্র অংশ অস্ত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত। বাকিটা সম্পূর্ণরূপে মানবকল্যাণ, স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশ সংরক্ষণের সেবায় নিয়োজিত।”
তিনি বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি নয়। আমরা এই শিল্পকে মানুষের প্রয়োজন মেটানো ও দেশের কল্যাণ বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে চাই।”
সরকারের প্রতিশ্রুতি: শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক উন্নয়নে পূর্ণ সমর্থন
রাষ্ট্রপতি পেজেশকিয়ান পুনরায় জোর দিয়ে বলেন, “সরকার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শিল্পের অগ্রগতি ও শক্তিশালীকরণে পূর্ণ সমর্থন দেবে। বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা, গবেষণা ও সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা বৈশ্বিক বাজারে আরও বড় অংশীদারিত্ব অর্জন করতে পারব।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের বিজ্ঞানীদের মর্যাদা জানি। সবাই হাতে হাত রেখে কাজ করব, যেন ইরান প্রযুক্তি ও জ্ঞানের শীর্ষে অবস্থান করতে পারে। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও আধুনিক প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের ওপর।”



