কুরআনকুরআন শিক্ষাধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

পবিত্র কুরআনে ‘আকল’-এর অর্থ

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: কুরআনে ‘তাআক্কুল’ (تعقل) বলতে বোঝানো হয়েছে এমন এক উপলব্ধিকে, যা বিশুদ্ধ ও সুস্থ ফিতরতের (প্রাকৃতিক স্বভাব) ওপর ভিত্তি করে গঠিত— এমন নয় যে তা নফসের প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয়নির্ভর আকাঙ্ক্ষার অনুসারী। অর্থাৎ, ‘আকল’ হচ্ছে এক আল্লাহপ্রদত্ত শক্তি, যার মাধ্যমে মানুষ সত্য ও সঠিক পথ চিনতে পারে এবং সৎকর্মে অগ্রসর হয়; এটি কেবল পার্থিব লাভ-ক্ষতি নির্ধারণের মাধ্যম নয়।

আল্লামা তাবাতাবায়ী (রহ.)-এর ব্যাখ্যা

 প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা তাবাতাবায়ী (রহ.), তাঁর মহান তাফসির আল-মিজান-এ সূরা বাকারার ২২৪ থেকে ২৪২ নম্বর আয়াতসমূহের ব্যাখ্যায় “কুরআনে আকলের প্রকৃত অর্থ” সম্পর্কে বলেন, কুরআনের ভাষায় ‘তাআক্কুল’ অর্থ এমন এক জ্ঞান ও বোধশক্তি, যা বিশুদ্ধ ফিতরতের সঙ্গে যুক্ত থাকে; সেই বোধ নয়, যা কামনা-বাসনা বা ইহলৌকিক প্রবৃত্তির প্রভাবে পরিচালিত হয়।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর কালাম (বাণী) এমনভাবে প্রকাশ করেছেন, যাতে ‘আকল’কে এমন এক শক্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যার সাহায্যে মানুষ তার ধর্মীয় জীবনে সঠিক পথ চিনতে পারে, হক্ব ও সত্যের জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং সৎকর্মের দিকে অগ্রসর হয়।

অতএব, যদি মানুষের বুদ্ধি এই আলোকিত পথে পরিচালিত না হয় এবং তার জ্ঞানের পরিধি কেবল দুনিয়াবি ভালোমন্দ, লাভ-ক্ষতির চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সেটিকে আর ‘আকল’ বলা যায় না।

 কুরআনের উদাহরণ

 যেমন, আল্লাহ তায়ালা সেইসব মানুষের কথা বর্ণনা করেছেন যারা কিয়ামতের দিন আফসোস করে বলবে:

وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ

“যদি আমরা শুনতাম বা চিন্তা করতাম (তাআক্কুল করতাম), তবে আমরা জাহান্নামবাসী হতাম না।” [সূরা আল-মুলক, আয়াত ১০]

এছাড়াও অন্যত্র বলা হয়েছে:

 أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌ يَعْقِلُونَ بِهَا أَوْ آذَانٌ يَسْمَعُونَ بِهَا ۖ فَإِنَّهَا لَا تَعْمَ الْأَبْصَارُ وَلَٰكِنْ تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي

الصُّدُورِ

“তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না, যাতে তাদের এমন হৃদয় হয় যা দিয়ে তারা চিন্তা করতে পারে, বা এমন কান হয় যা দিয়ে তারা শুনতে পারে? আসলে দৃষ্টিশক্তি অন্ধ হয় না, বরং বুকের ভেতরের হৃদয়ই অন্ধ হয়ে যায়।” [সূরা হজ, আয়াত ৪৬]

এই আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায়, ‘আকল’ এমন জ্ঞানের নাম, যা মানুষ নিজেই তার অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা অর্জন করে, অন্য কারও সহযোগিতা ছাড়া। অপরদিকে ‘শোনার ক্ষমতা’ (সামা) হলো এমন জ্ঞান, যা মানুষ অন্যের মাধ্যমে লাভ করে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই শর্ত হলো— ফিতরতের বিশুদ্ধতা ও হৃদয়ের আলোকিত অবস্থা; কারণ আল্লাহ বলেন, প্রকৃত বুদ্ধি সেই যা আলোকিত হৃদয়ের সঙ্গে যুক্ত, অন্ধ হৃদয়ের সঙ্গে নয়।

 আকল ও ফিতরতের সম্পর্ক

 আল্লাহ আরও বলেন:

 وَمَنْ يَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ إِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهُ

“যে ব্যক্তি ইবরাহিমের ফিতরতমূলক ধর্ম থেকে বিমুখ হয়, সে নিজেকে নির্বোধ ও মূর্খে পরিণত করেছে।” [সূরা বাকারা, আয়াত ১৩০]

এ আয়াতটি মূলত সেই হাদীসের বিপরীত উদাহরণ হিসেবে কাজ করে, যেখানে বলা হয়েছে:

العقل ما عبد به الرحمن

“আকল সেই (সত্তা) যা দ্বারা রহমানকে উপাসনা করা হয়।”

সব আলোচনার সারমর্ম এই যে— কুরআনের দৃষ্টিতে ‘আকল’ বা ‘বুদ্ধি’ হলো এমন উপলব্ধি, যা বিশুদ্ধ ফিতরতের সঙ্গে মিলিত হয়ে মানুষকে সত্যের পথে পরিচালিত করে। এ কারণেই আল্লাহ বলেন:

کَذَٰلِکَ یُبَیِّنُ اللَّهُ لَکُمْ آیَاتِهِ لَعَلَّکُمْ تَعْقِلُونَ

“এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শনসমূহ স্পষ্ট করেন, যাতে তোমরা চিন্তা করো।” [সূরা বাকারা, আয়াত ২৪২]

 অর্থাৎ, আল্লাহর ব্যাখ্যা ও নির্দেশই হচ্ছে জ্ঞানের পূর্ণতার ভূমিকা, আর সেই পূর্ণ জ্ঞানই মানুষকে প্রকৃত আকল ও প্রজ্ঞার পথে পৌঁছে দেয়। তদ্রূপ, অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:

وَتِلْکَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا یَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ

“আমরা মানুষের জন্য এসব উপমা দিই; কিন্তু এগুলোর প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে পারে কেবল জ্ঞানী ব্যক্তিরাই।” [সূরা আনকাবুত, আয়াত ৪৩]

উৎস: তাফসিরে আল-মিজান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩২৮

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button