বিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

নেতানিয়াহু কীভাবে ইসরায়েলের ক্ষমতার পুরো কাঠামো নিজের নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীভূত করছেন?

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক তিনটি উচ্চপর্যায়ের নিয়োগ শুধুমাত্র প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; এগুলো ইসরায়েলি ক্ষমতা কাঠামোয় এক গভীর ও কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের সংকেত বহন করছে।

২০২৫ সালের শেষভাগে এসে দখলকৃত ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে নেতানিয়াহু যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন—

  • অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেত–এর প্রধান,

  • বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ–এর প্রধান,

  • এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ,

—এই তিনটি পদই দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পৃথক ও ভারসাম্যপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। এখন সেগুলো একে একে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি প্রভাববলয়ে ঢুকে যাচ্ছে

এ সব ঘটছে এমন এক সময়ে, যখন ইসরায়েল এখনো তুফান আল-আকসা অপারেশনের ব্যর্থতা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে এবং সেই ব্যর্থতার তদন্ত কমিটি নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা চলছে।

শিন বেত প্রধানের নিয়োগ: স্বাধীন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে আনা

২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রয়টার্সের প্রতিবেদনে প্রকাশ—নেতানিয়াহুর সুপারিশে মেজর জেনারেল ডেভিড জিনি–কে শিন বেত–এর নতুন প্রধান হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়।

যিনি একজন পেশাদার সামরিক কর্মকর্তা; আগে তিনি স্থলবাহিনীর প্রশিক্ষণ কমান্ডে দায়িত্ব পালন করেছেন— যা শিন বেত–এর মতো গোয়েন্দা সংস্থার জন্য অস্বাভাবিক ব্যাকগ্রাউন্ড।

সুপ্রিম কোর্ট রোনেন বার–কে অপসারণকে আইনবিরোধী ঘোষণা করলেও, নেতানিয়াহু মন্ত্রিসভার ক্ষমতা ব্যবহার করে সেই সিদ্ধান্ত অকার্যকর করে দেন।

ইসরায়েলের সাবেক শিন বেত প্রধানসহ বহু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন— একজন অগোয়েন্দা সামরিক কর্মকর্তাকে শিন বেতের শীর্ষে বসানো সংস্থার পেশাদার স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং গোটা প্রতিষ্ঠানের কাজ রাজনৈতিক স্বার্থনির্ভর হয়ে পড়বে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এটি ছিল নেতানিয়াহুর প্রথম পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে তিনি নিরাপত্তা ও রাজনীতির সীমানাকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে দিতে শুরু করেছেন—গাজা যুদ্ধের ব্যর্থতার দায় থেকে নিজেকে রক্ষা করার অংশ হিসেবে।

সেনাবাহিনী ও চিফ অফ স্টাফ: পুরো সামরিক কাঠামোকে আনুগত্যের ছত্রছায়ায় আনা

২০২৫ সালের গ্রীষ্মে নেতানিয়াহু জেনারেল ইয়াল জমির–কে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ নিয়োগ দেন।
জমির লিকুদ দলের ঘনিষ্ঠ এবং নেতানিয়াহুর দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহযোগী।

এই নিয়োগের ফলে ইসরায়েলের ইতিহাসে প্রথমবার— সেনাবাহিনী, শিন বেত এবং মোসাদের মতো তিনটি প্রধান নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়।

ইসরায়েলের সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান আমোস ইয়াদলিন সতর্ক করে বলেন— এই কেন্দ্রীয়করণ নজরদারি ব্যবস্থাকে দুর্বল করবে এবং সামরিক সিদ্ধান্তগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।

প্রথাগতভাবে একটি স্বাধীন কমিটি এসব নিয়োগ যাচাই–বাছাই করে থাকে, যাতে রাজনৈতিক প্রভাব এড়ানো যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক নিয়োগগুলোতে সেই কমিটিকে প্রায় ‘আনুষ্ঠানিক সিলমোহরদাতা’তে রূপান্তর করা হয়েছে।

এটি দেখায়—নেতানিয়াহু নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের ওপর পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য ধারাবাহিকভাবে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন।

মোসাদ প্রধানের নিয়োগ: দক্ষতা নয়, পুরস্কৃত হলো ব্যক্তিগত আনুগত্য

২০২৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘোষণা করা হয়—রোমান গাফমান মোসাদের নতুন প্রধান হচ্ছেন। তিনি সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হলেও মোসাদ বা গোয়েন্দা কার্যক্রমে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। দীর্ঘদিন তিনি নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।

সরকার তাঁকে ‘‘যোগ্য ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন’’ বলে বর্ণনা করলেও, হা’আরেত্জ–এর বিশ্লেষণ স্পষ্ট— এটি নিছক রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার।

NDTV–এর তথ্য অনুযায়ী—

  • গাফমান পশ্চিম তীরের ধর্মীয় “এলে” স্কুলে শিক্ষা নিয়েছেন,

  • রুশ ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় দক্ষ নন,

  • এবং শক্তিশালী ধর্মীয়–জাতীয়তাবাদী মতাবলম্বী।

এই মতাদর্শ নেতানিয়াহু ও তাঁর কট্টর ডানপন্থী জোটের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

সাধারণত মোসাদের প্রধান হন বহু বছরের অভিজ্ঞ গোয়েন্দা কর্মকর্তা— যাতে প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক চাপমুক্ত থাকে।
কিন্তু এবার এমন একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যিনি প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতম পরিমণ্ডলের সদস্য। এটি প্রমাণ করে নেতানিয়াহু বিদেশে ইসরায়েলের সবচেয়ে গোপন ও সংবেদনশীল অভিযানগুলোও সরাসরি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছেন।

ইসরায়েল কি ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিরাপত্তা শাসনব্যবস্থার’ দিকে এগোচ্ছে?

নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক তিনটি নিয়োগ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়— এগুলো ইসরায়েলে একটি নতুন ক্ষমতা স্থাপত্য নির্মাণের অংশ, যেখানে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো আর স্বতন্ত্র নয়, বরং: একটি কেন্দ্রীভূত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিরাপত্তা কাঠামোয় রূপান্তরিত হচ্ছে, যার শীর্ষে রয়েছেন স্বয়ং নেতানিয়াহু।

২০২৩–২০২৫ সালের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকট তাঁকে বুঝিয়েছে— নিজের অবস্থান রক্ষার একমাত্র উপায় হলো নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা।

এই কাঠামো স্বল্পমেয়াদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দ্রুত করবে ঠিকই—
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে:

  • প্রতিষ্ঠানগত স্বাধীনতা ভেঙে পড়বে,

  • তথ্য–বিশ্লেষণে বৈচিত্র্য কমবে,

  • এবং গোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রাজনৈতিকীকরণ বাড়বে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো ইতিমধ্যেই সতর্ক করছে— দেশটি এমন এক পর্যায়ে প্রবেশ করছে যেখানে নিরাপত্তা নীতি আর প্রতিষ্ঠানের ভিতর থেকে আসে না, আসে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button