বিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর, ইরানের উত্থানে পশ্চিম হতভম্ব

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১০ নভেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ২০২৫ সালের শুরুতে পশ্চিমা মিডিয়ার আলোচনাগুলোর একটিমাত্র সাধারণ সুর—ইরানের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে গড়ে তোলা চাপ-কৌশল কার্যত ভেঙে পড়েছে। লন্ডন ও তেলআবিবের স্টুডিওতে বিশ্লেষকদের ভাষা আগের মতো আত্মবিশ্বাসী নয়; বরং বারবার ভেসে আসে অস্বস্তি, অবাকভাব এবং ব্যর্থ কৌশলের স্বীকারোক্তি। যে “নিষেধাজ্ঞা পুনরাগমন” বা স্ন্যাপব্যাক একসময় ইরানকে একঘরে করার প্রধান অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, এখন তা পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের কাছেই একটি অকার্যকর প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞা সক্রিয়, কিন্তু বাজারে ইরানি তেলের প্রবাহ অপ্রতিরোধ্য

পশ্চিমা-সমর্থিত গণমাধ্যম—বিবিসি, ইন্টারন্যাশনালসহ—এখন নিজস্ব তথ্যসূত্রের ভিত্তিতেই বলছে:

  • ইরান বর্তমানে প্রতিদিন ১.৪–১.৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রফতানি করছে,

  • ২০২৫ সালের রফতানি পরিমাণ নিষেধাজ্ঞার আগের সময়কেও ছাড়িয়ে গেছে,

  • পূর্ব এশিয়া—বিশেষত চীন—ইরানের তেলের প্রধান ও স্থায়ী ক্রেতায় পরিণত হয়েছে,“শেডো ফ্লিট” এখন কার্যত একটি প্রতিষ্ঠিত জ্বালানি পরিবহন নেটওয়ার্ক।

তেলের উৎস আড়াল, রিব্র্যান্ডিং, মধ্যস্বত্বভোগী কোম্পানি এবং আঞ্চলিক পরিশোধনাগার ব্যবহার—সব মিলিয়ে ইরানের রফতানি আজ একটি মাল্টি-লেয়ার্ড কমার্স সিস্টেম, যা একক নিষেধাজ্ঞা কাঠামোকে অকার্যকর করে তুলেছে।

লন্ডন ও তেলআবিবের স্টুডিওতে অস্বস্তির দৃশ্য

পশ্চিমা টেলিভিশন বিতর্কগুলোতে বারবার শোনা যাচ্ছে তিনটি প্রশ্ন:

১. স্ন্যাপব্যাক কেন বাজারে ঝাঁকুনি আনতে ব্যর্থ হলো?

২. চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আঞ্চলিক ক্রেতারা যুক্তরাষ্ট্রের চাপ উপেক্ষা করছে কেন?

৩. ইরানের নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর সক্ষমতা এত দ্রুত কীভাবে উন্নত হলো?

বিশ্লেষকদের উপলব্ধি— ইরানের চাপ-সহনশীলতা এবং অভিযোজনক্ষমতা পশ্চিমের প্রাথমিক মূল্যায়নের তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল। নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় ইরান শুধু স্থিতিশীল হয়নি, বরং ব্যবস্থাগত বিকল্পপথ গড়েছে।

সংগঠিত বিশ্লেষণ: ইরান কীভাবে নিষেধাজ্ঞা কাঠামোকে অকার্যকর করল

১. বৈশ্বিক বাজারের প্রয়োজনীয়তা

বিশ্ববাজারে সরবরাহজনিত অনিশ্চয়তা রয়েছে। বাজার ইরানি তেলকে বাতিল করার ব্যয়সাধ্য অবস্থায় নেই।

২. রফতানি পথের বৈচিত্র্য

ইরান একাধিক রুট ও মধ্যবর্তী স্তর ব্যবহার করে:

  • শেডো ফ্লিট

  • মালিকানা-গোপন জাহাজ

  • তৃতীয় দেশের পরিশোধনাগার

  • ভিন্ন নামে পুনর্বিক্রয়

এটি নিষেধাজ্ঞাকে প্রশাসনিক প্রচেষ্টা, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অকার্যকর ব্যবস্থায় পরিণত করেছে।

৩. কৌশলগত অংশীদারদের অবস্থান

চীন ও রাশিয়া এখন যুক্তরাষ্ট্রের একপাক্ষিক নীতিতে সায় দেয় না। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশও বাজার-নির্ভর বাস্তবতার কারণে নিষেধাজ্ঞা সমর্থনে অনিচ্ছুক।

৪. সক্রিয় প্রতিরোধ কৌশলের অর্থনৈতিক প্রয়োগ

রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা, বেসরকারি নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে adaptation ecosystem, যা নিষেধাজ্ঞা কাঠামোকে প্রায় অসার করে দিয়েছে।

স্ন্যাপব্যাক: হুমকি ছিল বড়, কার্যকারিতা প্রায় শূন্য

নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতি ছাড়া স্ন্যাপব্যাক কার্যকর সম্ভব নয়—এবং চীন-রাশিয়ার বিরোধিতায় এটি বাস্তবে অসম্ভব।
ফলে স্ন্যাপব্যাক এখন পশ্চিমা আলোচনায় একটি গ্রহণযোগ্য ধারণা হলেও কৌশলগতভাবে মৃত হাতিয়ার

বিশ্লেষকদের ভাষায়: “স্ন্যাপব্যাক এখন Symbolic Enforcement — কোনো অপারেশনাল ফল নেই।”

জ্বালানি ভূরাজনীতিতে ইরানের স্থায়ী উত্থান

২০২৫ সালের বাজার পরিস্থিতি স্পষ্ট করেছে যে—

  • ইরান নিষেধাজ্ঞা সহ্য করেছে,

  • বাজারের দিকে নতুন চ্যানেল খুলেছে,

  • এবং বৈশ্বিক জ্বালানি রাজনীতিতে বাধ্যতামূলক বিবেচ্য এক শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

বিবিসি থেকে ইন্টারন্যাশনাল পর্যন্ত এখন একটি সুরই শোনা যায়: “ইরানের উত্থান পশ্চিমা নীতির ব্যর্থতার প্রতীক; নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়নি।”

পশ্চিমা কূটনৈতিক বাস্তবতায় কৌশলগত পুনর্মূল্যায়ন

পশ্চিমা রাজনৈতিক মহলে এখন ক্রমবর্ধমানভাবে উচ্চারিত হচ্ছে একটি শব্দ:

“Strategic Reassessment”— বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।

এটি নির্দেশ করছে:

  • পূর্বের হিসাব ভুল ছিল,

  • নিষেধাজ্ঞা কাঠামো কৌশলগতভাবে দুর্বল,

  • এবং ইরান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তি-সম্পর্কে অপরিহার্য এক খেলোয়াড়।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button