জীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

নাহাজুল বালাগায় মুমিন ও মুনাফিকের চিহ্ন

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: নাহজুল বালাগা হিকমত ৪৫-এ ইমাম আলী (আ.) আমাদের শেখান যে, প্রকৃত মুমিন ও মুনাফিককে আলাদা করার চাবিকাঠি হলো হৃদয়ের দিক। যে ব্যক্তি আলী (আ.)-এর প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা রাখে, সে মুমিন; যে বিদ্বেষ ও ঘৃণা পোষণ করে, সে মুনাফিক। ইমামের এই গভীর বাক্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ঈমান কেবল মুখের বিশ্বাস নয়, বরং হৃদয় ও নৈতিকতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার একটি অনন্য মানদণ্ড আছে।হিকমত ৪৫-এর মূল বক্তব্য:

لَوْ ضَرَبْتُ خَیْشُومَ الْمُؤْمِنِ بِسَیْفِی هَذَا عَلَی أَنْ یُبْغِضَنِی مَا أَبْغَضَنِی، وَ لَوْ صَبَبْتُ الدُّنْیَا بِجَمَّاتِهَا عَلَی الْمُنَافِقِ عَلَی أَنْ یُحِبَّنِی مَا أَحَبَّنِی؛ وَ ذَلِکَ أَنَّهُ قُضِیَ، فَانْقَضَی عَلَی لِسَانِ النَّبِیِّ الْأُمِّیِّ (صلی الله علیه وآله) أَنَّهُ قَالَ: “یَا عَلِیُّ لَا یُبْغِضُکَ مُؤْمِنٌ وَ لَا یُحِبُّکَ مُنَافِقٌ”

যদি আমি এই তলোয়ার দিয়ে মুমিনের নাকের মাথায় আঘাত করি, যে আমাকে ঘৃণা করে, সে আমাকে ঘৃণা করবে না। আর যদি আমি পুরো দুনিয়া মুনাফিকের ওপর ঢেলে দিই, যে আমাকে ভালোবাসে, সে আমাকে ভালোবাসবে না। কারণ এটি পূর্বনির্ধারিত হয়েছে, এবং তা উম্মি নবীর মুখে প্রকাশ পেয়েছে: ‘হে আলী! কোন মুমিন তোমাকে ঘৃণা করবে না, আর কোন মুনাফিক তোমাকে ভালোবাসবে না।

ব্যাখ্যা:
ইমাম আলী (আ.) এখানে একটি গভীর সত্য উদঘাটন করেছেন: মুমিন তার প্রতি প্রাকৃতিকভাবে ভালোবাসা রাখে কারণ তিনি মুমিনের আত্মার সাথে মানসিক ও নৈতিক সাদৃশ্য বজায় রাখেন। অন্যদিকে মুনাফিক তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, কারণ তার নৈতিকতা ও বিশ্বাস ইমাম আলী (আ.)-এর গুণাবলীর বিপরীতে অবস্থান করে।

ইমামের এই বাক্য প্রমাণ করে যে, আলী (আ.)-এর পরিচিতি ও চরিত্র মুমিন ও মুনাফিককে আলাদা করার একটি অনন্য মানদণ্ড। মুমিনরা তার মহান গুণাবলীর ছায়ায় নিজেদের প্রতিফলন দেখতে পায় এবং তাই তার প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য জাগে। আর মুনাফিকরা তার সততা ও নৈতিক গুণাবলীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, ফলে তার প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ জন্মায়।

ইতিহাসে এর অনুকরণীয় প্রমাণও রয়েছে। যেমন, ‘হাদিসে কফি’ তে বলা হয়েছে, হাবিশিয়ান এক ব্যক্তিকে মুমিনদের হাতে ধরাশায়ী করা হয়েছিল। তিনি আলী (আ.)-এর ন্যায়বিচার ও উদারতার মুখোমুখি হয়ে তৎক্ষণাত সঠিক পথে ফিরে এসেছিলেন। অন্যদিকে, ইবন মুলজেমের ঘটনা প্রমাণ করে যে, মুনাফিক বা শত্রু সর্বদা তার বিদ্বেষ ও ইচ্ছার দ্বারা প্রভাবিত হয়।

পৃথিবীর ইতিহাস এবং নবী মুহাম্মদ (সা.) ও সাহাবীদের বিবরণ অনুযায়ী, মুমিনরা আলী (আ.)-এর প্রতি প্রেম ও আনুগত্যের মাধ্যমে স্বতঃসিদ্ধভাবে চিহ্নিত হয়, আর মুনাফিকরা বিদ্বেষ ও ঘৃণার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেমন বেলাদুরি এবং তিরমিজি লিখেছেন, আনসাররা মুনাফিকদের আলী (আ.)-এর প্রতি বিদ্বেষের মাধ্যমে চিনতে পারত।

উপসংহার:
নাহজুল বালাগা হিকমত ৪৫-এ ইমাম আলী (আ.) স্পষ্ট করেছেন যে, প্রকৃত বিশ্বাস ও মুনাফিকত্ব নির্ণয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সূচক হলো আলী (আ.)-এর প্রতি হৃদয়ের সৎ ভালোবাসা। মুমিনরা তাকে ভালোবাসে, মুনাফিকরা তাকে ঘৃণা করে—এটাই ঈমান ও দ্ব্যর্থবাদ চিহ্নিত করার চিরন্তন মানদণ্ড।

সূত্র :

১.  কাফি, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ২৬৪, হাদিস ২৫।

২.  নাহজুল বালাগা ব্যাখ্যা, আল্লামা শুশত্রি, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৪৩৫।

৩.  নাহজুল বালাগা ব্যাখ্যা, ইবন আবি হাদীদ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৮৩।

৪. হিকমতপূর্ণ বাণীর সূত্র: এই উজ্জ্বল এবং গভীর অর্থপূর্ণ বাণীটি ইমাম আলী (আ.)-এর একটি খুতবাহের অংশ, যা “রফীক বিন ফারকাদ” ইমাম (আ.) থেকে ন্যস্ত করেছেন। বহু শিয়াহ ও সুন্নি ইতিহাসবিদ ও রাওয়ী এই বাণীটি তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সিদ্দি রযি-এর পূর্বে এবং পরেও। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: আবু জাফর তাবারি তাঁর গ্রন্থ বিশারা আল-মুস্তফা-তে, শায়খ তুসি আমালি-তে, জমকাশরী রাবি’ আল-আবরার-এ, মুসলিম তাঁর সহিহ-এ (কিতাবুল ইমান, বাব ৩৩, হাদিস ১৩১), ইমাম আহমাদ মসনাদ-এ, নাসায়ি সুনান-এ, ইবন আবদুলবার ইস্তিয়াব-এ, আবু নাঈম ইসফাহানি হিল্যাহ-তে, মুত্তাকি হিন্দি কনজুল আমাল-এ এবং হাকিম মুস্তদারেক-এ। এই হিকমতপূর্ণ বাণীর শেষ অংশ, যা নবী করিম (সা.) থেকে ন্যস্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখিত হয়েছে, যদিও কিছু পার্থক্যও আছে।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button