বিশ্বকুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

নারীর পর্দা নয়, স্বাধীনতা চাই: পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৬ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ভূমিকা: কেন আমাদের নারীদের পুরুষদের অসুস্থ মনকে কেন্দ্র করে হিজাব পরতে হবে?! কেন আমাদের গ্রীষ্মের তাপেও হিজাব রাখতে হবে যেন শ্রদ্ধেয়জনেরা (মহাশয়রা)বিভ্রান্ত না হন? এটা কি ভালো হবে না যদি পুরুষরা আমাদের দিকে তাকানো বন্ধ করে দেন?! হিজাব কেবল নারীর ব্যক্তিগত পোশাক নয়, এটি তার সামাজিক নিরাপত্তা, পারিবারিক স্থিতিশীলতা এবং মর্যাদার প্রতীক। ইসলাম শুধু নারীর দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়নি; পুরুষদেরও দৃষ্টি ও শালীনতা বজায় রাখা অপরিহার্য। হিজাব নারীকে কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করে, পরিবারের স্নেহ ও সম্মান নিশ্চিত করে, এবং নৈতিক সমাজের স্থায়িত্বে অবদান রাখে।

পারিবারিক স্থিতিশীলতা ও নৈতিক মূল্যবোধ
হিজাব পরিবারকে সংহত রাখে। নারীরা যদি সমাজে অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রদর্শন করে, স্বামী তার স্ত্রীকে সবচেয়ে সুন্দর মনে না করতে পারে, এবং পারিবারিক স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ণ হয়। হিজাব পরিবারের মধ্যে ভালোবাসা, সম্মান ও নৈতিকতা রক্ষা করে।

وَ مِنْ آياتِهِ أنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزواجاً لِتَسْكُنُوا الَيْها وَ جَعَلَ بَينَكُمْ مَوَدَّةً و رَحْمَةً انَّ فِى ذلِكَ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُوْن‏

আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে। সূরা রূম ৩০:২১

নারীদের ও পুরুষদের জন্য হিজাব ও শালীনতার নির্দেশ

ইসলামের শিক্ষায় হিজাব ও শালীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইমাম আলী (আ.) বলেন:
«أَحْسَنُ مَلَابِسِ الدِّينِ الْحَيَاء»
(ধর্মের সবচেয়ে সুন্দর পোশাক হলো লজ্জা/শালীনতা)।

নবী করিম (সা.) বলেন:
«إنَّ اللّهَ يُحِبُّ الحَيِىَّ الحَليمَ العَفيفَ المُتَعفِّفَ»
(আল্লাহ ধৈর্যশীল, শালীন এবং পরিশ্রুত ব্যক্তিকে ভালোবাসেন)।

ইমাম আলী (আ.) আরও বলেন:
«العِفَّةُ رَأسُ كُلِّ خَيرٍ»
(শালীনতা সব সৌভাগ্যের মূল)।

ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন:
«لَا حَيَاءَ لِمَنْ لَا دِينَ لَه»
(যার মধ্যে লজ্জা নেই, তার মধ্যে ধর্মও নেই)।

শালীনতা মানুষের আত্মা রক্ষা করে এবং তাকে নীচত্ব থেকে দূরে রাখে:
«العَفافُ يَصونُ النَّفسَ و يُنَزِّهُها عَنِ الدَّنايا»

এটি এমনকি সর্বোচ্চ ইবাদতের মধ্যে গণ্য হয়:
«افضَلُ العبادَةِ العِفافُ»
(সবচেয়ে উত্তম ইবাদত হলো শালীনতা)।

ইমাম মুহাম্মাদ বাকের (আ.) বলেন:
«مَا عُبِدَ اللَّهُ بِشَيْ‏ءٍ أَفْضَلَ مِنْ عِفَّةِ بَطْنٍ وَ فَرْج‏»
(কোনো ইবাদত আল্লাহর নিকট উত্তম নয়, পেট ও যৌন বিষয়ে শালীনতার চেয়ে)।

পুরুষদেরও দৃষ্টি ও শালীনতার নিয়ম

ইসলাম পুরুষদেরও নির্দেশ দেয় যেন তারা হিজাবের মতো শালীনতা বজায় রাখে। সূরা নূর ৩০-এ বলা হয়েছে:
«قُلْ لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ»
(মুমিন পুরুষদের বল, তারা তাদের দৃষ্টি নামিয়ে রাখুক এবং শালীনতা রক্ষা করুক। এটি তাদের জন্য পবিত্র। আল্লাহ জানেন তারা কী করে)।

নবী (সা.) বলেছেন, যে পুরুষ নারীর দিকে অশ্লীল দৃষ্টি দেয়, তা শয়তানের বিষাক্ত তীরের মতো।

পুরুষদেরও অনৈতিক পোশাকে বের হওয়া অনুমোদিত নয়। যেমনটি নারী দেখলে উত্সাহিত হয়, পুরুষও অনৈতিক দৃষ্টিতে প্রলুব্ধ হয়। এজন্য পুরুষেরও শালীনতা বজায় রাখা আবশ্যক।

ইমাম আলী (আ.) বলেছেন:
«لَیسَ لِلرَّجُلِ أَنْ یکشِفَ ثِیابَهُ عَنْ فَخِذَیهِ وَ یجْلِسَ بَینَ قَوْمٍ»
(পুরুষের পক্ষে উপযুক্ত নয় তার প্যান্ট বা লোয়ার অংশ দেখানো এবং লোকসমক্ষে বসা)।

এছাড়াও তিনি বলেছেন:
«عَلَیکمْ بِالصَّفِیقِ مِنَ الثِّیابِ فَإِنَّهُ مَنْ رَقَّ ثَوْبُهُ رَقَّ دِینُهُ»
(পাতলা কাপড় পরা উচিত নয়; যার কাপড় পাতলা, তার ধর্মও পাতলা)।

হিজাবের লক্ষ্য ও নারী-পুরুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য

নারী সৌন্দর্যের প্রতীক, পুরুষ আকর্ষণের। নারী স্বভাবগতভাবে নিজেকে প্রদর্শন করতে চায়, পুরুষ চোখচোরি করতে চায়। নারী নিজস্ব প্রলুব্ধতা ও আকর্ষণ দ্বারা পুরুষকে প্রলুব্ধ করে। এজন্য নারীকে হিজাব পরতে বলা হয়েছে।

গবেষণা দেখায়, পুরুষরা নারীর শরীর দেখলে প্রলুব্ধ হয়, কিন্তু নারীরা পুরুষদের দেখলে ততটা প্রলুব্ধ হয় না। সাইকোলজি অনুযায়ী, নারীর পুরো শরীর পুরুষের জন্য উত্তেজক হলেও, পুরুষের শরীর নারীর জন্য সেই প্ররোচনা সৃষ্টি করে না।

অতএব, নারীর জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক, পুরুষের জন্য শালীনতা সমানভাবে প্রযোজ্য। নারীর নিজস্ব স্বাভাবিক প্রলুব্ধতার কারণে তিনি মূল লক্ষ্য, পুরুষ শুধুমাত্র প্রলুব্ধ হয়ে থাকে।

নারীর সামাজিক নিরাপত্তা ও হিজাবের হিকমাত

হিজাব শুধুমাত্র পুরুষদের উদ্দীপনা রোধ করার জন্য নয়; এটি নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সূরা আহযাব (আয়াত ৫৯)-এ আল্লাহ তাআলা বলেন:

«یا أَیُّهَا النَّبِیُّ قُلْ لِأَزْواجِكَ وَ بَناتِكَ وَ نِساءِ الْمُؤْمِنینَ یُدْنینَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلاَبِیبِهِنَّ ذلِكَ أَدْنى‏ أَنْ یُعْرَفْنَ فَلا یُؤْذَیْنَ وَ كانَ اللَّهُ غَفُوراً رَحیماً»

(হে নবী! তোমার স্ত্রী ও কন্যা এবং মুমিন নারীদের বল, তারা তাদের জালাবিব—লম্বা রোশাড়—ধরে রাখুক। এতে তারা চিহ্নিত হয় এবং কষ্ট পাই না। আল্লাহ সর্বদা ক্ষমাশীল ও দয়ালু)।

একটি সুস্থ সমাজে পুরুষদের উচিত তাদের যৌন চাহিদা বৈধভাবে, বিবাহের মাধ্যমে পূরণ করা এবং মহিলাদের দিকে হিংস্র বা কামুক দৃষ্টিতে তাকানো থেকে বিরত থাকা। তবে সব পুরুষই এটি মানবে না; কিছু শীঠ বা দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি সবসময় থাকতে পারে। সেই কারণে নারীদেরও নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হিজাব মেনে চলা প্রয়োজন। ইসলামের নির্ধারিত সীমার মধ্যে নারীর আড়াল থাকা তার মর্যাদা ও সন্মান রক্ষা করে এবং নৈতিকতার অভাবসম্পন্ন বা কুপ্রকৃতির লোকদের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়। পশ্চিমা সমাজের অভিজ্ঞতা এ ব্যাপারে প্রমাণস্বরূপ—হিজাববিহীনতা ও নগ্নতার সংস্কৃতি কিভাবে সমাজ এবং পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা স্বীকার করেছেন এখানকার বিজ্ঞানীরাও।

হিজাব ও নারীর মর্যাদা

হিজাব নারীর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব রক্ষায় সহায়ক। নগ্নতা ও অতিরিক্ত সাজ-সজ্জার চাপ সমাজে নারীকে একটি পণ্য বা খেলনা হিসেবে দাঁড় করায়। এ ধরনের সমাজে নারীর জ্ঞান, নৈতিকতা ও ক্ষমতা উপেক্ষিত হয়, এবং কেবল তার সৌন্দর্য ও প্রদর্শনীই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।

পশ্চিমা সমাজে বা ইসলামের পূর্ববর্তী যুগে, যারা সর্বাধিক খ্যাতি ও অর্থ উপার্জন করতেন, তারা মূলত সেসব নারী যাদের চরিত্রহীন ও আত্মপ্রকাশমূলক জীবনযাপন করতেন। ইসলামী বিপ্লবের পরে, নারীরা আবার তাদের মর্যাদা ফিরে পেয়েছেন এবং হিজাবের সাথে সক্রিয় সামাজিক ও যুদ্ধক্ষেত্রের কাজেও অংশগ্রহণ করেছেন।

গ্রীষ্মের তাপ কোনো অজুহাত নয়

হিজাব বিরোধীরা প্রায়শই গ্রীষ্মের তাপকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, প্রায় ১৪০০ বছর ধরে মুসলিম ও অমুসলিম নারীরা গরমে হিজাব মেনে চলেছেন। এটি কিছুটা কষ্টসাধ্য হলেও অসহ্য নয়, এবং কোনো যৌক্তিক কারণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। পশ্চিম এশিয়ার কৃষিক্ষেত্রেও নারীরা কঠোর গরমে কাজ করলেও হিজাব বজায় রেখেছেন। এভাবে, হিজাবের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব প্রমাণিত হয়—নারীর নিরাপত্তা, পারিবারিক স্থিতিশীলতা, মর্যাদা এবং নৈতিকতার রক্ষা।

পাদটীকা:

১. আল-ইউনুল হিকম ওয়াল-মাওয়ায, লায়থি ওয়াসতি, আলী বিন মুহাম্মদ, সংশোধক: হোসনি বীরজান্দি, হোসেইন, কোম,১৩৭৬ হি.শ., খণ্ড ১১৮।

২. আল-কাফী, কুলাইনী, মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব বিন ইসহাক, সংশোধক: গফফারি, আলী আকবর, তেহরান, ১৪০৭ হি.ক., খণ্ড ২, পৃ. ১১২।

৩. আল-ইউনুল হিকম ওয়াল-মাওয়ায, একই, পৃ. ৪৫।

৪. বিহারুল আনোয়ার, মজলিসী, মুহাম্মদ বাকের বিন মুহাম্মদ তাকি, বেইরুত, ১৪০৩হি.ক., খণ্ড৭৫, পৃ. 111।

৫. আল-ইউনুল হিকম ওয়াল-মাওয়ায, একই, পৃ. ২১।

৬. আল-কাফী, একই, খণ্ড ২, পৃ. ৭৯।

৭. ঘুররুল হিকম ও দাররুল কালিম, তামিমী আমদি, আব্দুল ওয়াহিদ বিন মুহাম্মদ, সংশোধক: রেজাই, সৈয়দ মাহদী, কোম,১৪১০ হি.ক., পৃ. ২৭।

৮. রওদাতুল মুত্তাকিন, মজলিসী, মুহাম্মদ তাকি, কুম,১৪০৬ হি.ক., খণ্ড ১২, পৃ.৭৮

৯. আল-ইউনুল হিকম ওয়াল-মাওয়ায, একই, পৃ. ১৩১।

১০. আল-কাফী, একই, খণ্ড ২, পৃ. ৭৯।

১১. বিহারুল আনোয়ার, একই, খণ্ড ১০১, পৃ. ৩৮।

১২. ওসায়েলুশ শিয়া, শেখ হারামলী, মুহাম্মদ বিন হাসান, কুম, ১৪০৯ হি.ক., খণ্ড ৫, পৃ.২৩।

১৩. তুহফাতুল আকুল, ইবনু শায়বা হারানী, হাসান বিন আলী, সংশোধক: গফফারি, আলী আকবর, কোম, ১৩৬৩হি.ক., পৃ. ১১৩।

১৪. জেওরুল আফাফ, হেদায়েতখাহ, সতার, মাশহাদ, ১৩৭৫ হি.শ., পৃ. ২৩০-২৩৫।

১৫. মোতাহারী, মর্তযা, মাশহাদ১৩৯০হি.শ., খণ্ড ১৯, পৃ.৪৩৭

১৬. রওজান শিনাসি একলাকি জেনিস, পেরে, রোজা, তেহরান,১৩৬১ হি.শ., পৃ.৪৪।

১৭. দায়রা-মাফারেক ফিকহ, মাকারেম শিরাজী, নাসের, কোম, ১৪২৭ হি.ক., খণ্ড ১, পৃ. ৮৫-৮৯।

১৮. পয়ামুল কোরআন, মাকারেম শিরাজী, নাসের, তেহরান, ১৩৮৬ হি.শ., খণ্ড ২, পৃ. ৪৪৬।

১৯. তাফসীর নুমুনা, মাকারেম শিরাজী, নাসের, তেহরান, ১৩৭৪ হি.শ., খণ্ড ১৪, পৃ. ৪৪৩-৪৪৪।

২০. একই, খণ্ড ১৪, পৃ.৪৪৬।

আরও পড়ুন

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button