নবী করিম (সা.) যখন ‘ফাদাক’হযরত ফাতিমা ( সা.আ.)-কে দান করেছিলেন, তখন কেন নির্দিষ্ট কোনো সাক্ষীর উপস্থিতি নেওয়া হয়নি?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ফাদাক দান প্রসঙ্গে — কেন নবী করিম (সা.) সাক্ষী আনেননি, এবং হযরত হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.) কি এ ঘটনার সাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন? সম্মানিত পাঠকদের জন্য উত্তর নিম্নে উপস্থাপিত হলো।
প্রশ্ন–উত্তর
প্রশ্ন ১. কোরআনে লেনদেন বা দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে দুই বা তিনজন সাক্ষী নেওয়া এবং লিখিত দলিল তৈরির নির্দেশ রয়েছে। তাহলে কেন নবী করিম (সা.) ফাদাক ভূমি দান করার সময় কোনো সাক্ষী আনলেন না এবং লিখিত দলিল প্রস্তুত করলেন না, যাতে হযরত ফাতিমা (সা.আ.) কেবলমাত্র আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-কে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করতে বাধ্য হন?
প্রশ্ন ২. কিছু সূত্রে উল্লেখ আছে যে হযরত হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.) এবং আরও কয়েকজনকে সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
১.এই দুই মহান সন্তান কি সে সময় এমন বয়সে ছিলেন যে তাদের সাক্ষ্য আদালতে গ্রহণযোগ্য হতো?
২.উল্লিখিত পাঁচজন (বা যাদের নাম সাক্ষী হিসেবে এসেছে) কি সত্যিই নবী করিম (সা.)-এর উপস্থিতিতে দান-ঘটনার সাক্ষী ছিলেন এবং তা প্রত্যক্ষ করেছেন?
সংক্ষিপ্ত উত্তর
১. হযরত ফাতিমা (সা.আ.) প্রথমে যুক্তি দিয়েছিলেন যে ফাদাক তাঁর পিতা নবী করিম (সা.)-এর পক্ষ থেকে উপহারস্বরূপ দেওয়া হয়েছিল। তিনি সাক্ষী হিসেবে হযরত আলী (আ.) ও উম্মে-আইমান (রা.)-এর নাম উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়নি। এরপর তিনি যুক্তি দেন যে ফাদাক তাঁর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্য। উপহারের ক্ষেত্রে প্রচলিত সামাজিক ও আইনি রীতি ছিল—যাকে উপহার দেওয়া হচ্ছে, তার জন্য আলাদা সাক্ষী নেওয়া আবশ্যক নয়। তাই নবী করিম (সা.) ফাদাক দান করার সময় সাক্ষী আনেননি।
২. সাক্ষ্যের প্রসঙ্গে—হ্যাঁ, কিছু সূত্রে হযরত হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.)-এর নাম সাক্ষী হিসেবে এসেছে। তবে সে সময় তারা শিশু ছিলেন, ফলে আদালতে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই মূলত হযরত আলী (আ.) ও উম্মে-আইমান (রা.)-এর সাক্ষ্যই প্রাধান্য পেয়েছিল।
১. ফাদাক (বাগে ফাদাক) ও দানের প্রেক্ষাপট
ফাদাক ছিল মদিনার নিকটবর্তী একটি উর্বর কৃষি অঞ্চল। যুদ্ধ ছাড়াই এটি নবী করিম (সা.)-এর হেফাজতে আসে। পরবর্তীতে হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-কে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। তিনি দাবি করেছিলেন যে জীবদ্দশায় নবী করিম (সা.) তাঁকে এ ভূমি দান করেছিলেন এবং তিনি এর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তবে খলিফা আবু বকর এর সময়ে তিনি পুনরায় তা দাবি করেন।
২. কেন উপহারে সাক্ষীর প্রয়োজন হয়নি
ইসলামী সমাজে উপহার প্রদানের ক্ষেত্রে সাধারণত একাধিক সাক্ষী নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল না। কারণ উপহার প্রদান নিজেই প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে গণ্য হতো। তাই নবী করিম (সা.) ফাদাক দান করার সময় আলাদা সাক্ষীর প্রয়োজন মনে করেননি।
৩. সাক্ষীদের প্রসঙ্গ
সূত্রে উল্লেখ আছে যে হযরত আলী (আ.) ও উম্মে-আইমান (রা.) সাক্ষী ছিলেন। হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.)-এর নামও কিছু বিবরণে এসেছে, তবে তারা তখন শিশু ছিলেন এবং আদালতে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলে মূল সাক্ষ্য হিসেবে আলী (আ.) ও উম্মে-আইমান (রা.)-এর নামই গুরুত্ব পেয়েছে।
৪. লিখিত দলিল না থাকা
বহু বিশ্লেষক মনে করেন, দানের বিষয়টি লিখিতভাবে দলিলবদ্ধ হয়নি কারণ সে সময় উপহারের ক্ষেত্রে লিখিত চুক্তি বাধ্যতামূলক ছিল না। সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে মৌখিক দানই যথেষ্ট স্বীকৃত ছিল। তাই দলিল না থাকা অস্বাভাবিক বলে গণ্য হয়নি।
সারাংশ
১.ফাদাক ভূমি: মদিনার নিকটবর্তী উর্বর কৃষি অঞ্চল, যুদ্ধ ছাড়াই নবী করিম (সা.)-এর হেফাজতে আসে এবং পরে হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-কে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।
১- সাক্ষীর প্রশ্ন:
-
- উপহারের ক্ষেত্রে সাধারণত আলাদা সাক্ষী নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল না।
- তাই নবী করিম (সা.) ফাদাক দান করার সময় সাক্ষী আনেননি বা লিখিত দলিল তৈরি করেননি।
২- সাক্ষীদের নাম:
-
- হযরত আলী (আ.) ও উম্মে-আইমান (রা.)-এর নাম সাক্ষী হিসেবে পাওয়া যায়।
- কিছু সূত্রে হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.)-এর নামও এসেছে, তবে তারা তখন শিশু ছিলেন, তাই আদালতে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয়নি।
৩- লিখিত দলিল না থাকা:
-
- সে সময় উপহারের ক্ষেত্রে লিখিত দলিল বাধ্যতামূলক ছিল না। মৌখিক দানই সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল।
সারকথা: ফাদাক দান প্রসঙ্গে সাক্ষী ও দলিলের প্রশ্নটি পরবর্তী সময়ে বিতর্কের জন্ম দেয়, কিন্তু নবী করিম (সা.)-এর যুগে উপহার প্রদানের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সাক্ষী বা দলিলের প্রয়োজন ছিল না।
সূত্র :
১. অভিধান ‘ফাদাক ভূমি হযরত আলী (আ.)-এর সন্তানদের দান করবার সময়’ থেকে নেওয়া, প্রশ্ন নম্বর ৩৪২৫।
২. “‘وَ آتِ ذَا الْقُرْبی حَقَّهُ وَ الْمِسْكینَ وَ ابْنَ السَّبیلِ وَ لا تُبَذِّرْ تَبْذیراً’ (সূরা ইসরাঃ ২৬)।”
৩. আলী বন ইব্রাহীম, ‘তাফসীর ক্কোমি’, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৫৫, বসন : দারুল কিতাব, কোম, চতুর্থ মুদ্রণ, ১৩৬৭ শ্রাবণ।”
৪.হাসকানি, উবাইদুল্লাহ বিন আহমদ, ‘শাওয়াহিদু অন্তানজীল লিকোয়াঈদ আত-তফদিল’, অনুষন্ধান : মাহমুদী, মুহাম্মাদ বাকের, খণ্ড ১, পৃঃ৪৩৮-৪৪৫, সংস্করণ : সংগঠন প্রকাশ ও প্রকাশনা, মন্ত্রী প্রকাশনা, তেহরান, প্রথম মুদ্রণ, ১৪১১ হি.”
৫. অভিধান ‘হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-র জন্য ফাদাকের মালিকানার জন্য কোরআনীয় যুক্তি’, প্রশ্ন নম্বর ২৪৭৩৮।
৬. তাবারি আমেলি সঘীর, মুহাম্মদ বিন জরীর বিন রুস্তম ‘দলাইল আল্ ইমামা’, পৃঃ১১৮, প্রকাশনা : বায়’সত, কোম, প্রথম মুদ্রণ, ১৪১৩ হি।
৭.অভিধান ‘ঘদীর এবং খলিফা আবু বকর-এর বিরুদ্ধে সাহাবীদের আপত্তিহীনতা’, প্রশ্ন নম্বর ১৫২৬।
৮. নাজাফী, মুহাম্মদ হাসান (সাহি ‘জাওয়াহের’), ‘মাজমুঅ্ আসারেল’, খণ্ড ৪, পৃঃ৬৫, প্রতিষ্ঠান : মোসসা সাহিবুজ জামান, মাশহাদ, ১৪১৫ হি।”
৯. শাইখ হর আমেলি, মুহাম্মদ বিন হাসান, ‘তাফসীল ওয়ারাসায়েল’ ইলি তাহসীল মাসায়েল ইশশারিয়া’, খণ্ড ২৭, পৃঃ২৯৩, প্রতিষ্ঠান : আল্ আলবায়াতে (আ.), কোম, প্রথম মুদ্রণ, ১৪০৯ হি।
১০. “এই সাধারণ নীতি ছিল যে ফিকহ ও আইন অনুযায়ী: ‘البینه علی المدعی و الیمین علی المدعی علیه (المنکر)’; (ثقة الإسلام কুলাইনি, ‘আল-কাফি’, খণ্ড ৭, পৃঃ৩৬১, দারু কুতুবি ইসলামিয়া, তেহরান, ১৩৬৫ শ্রাবণ; সোদুক, ‘আল্লা আলশারাঈ’, খণ্ড ২, পৃঃ৫৪১, মক্তাবা আদাউরি, কোম, ও তারিখ অনির্দিষ্ট)।”
১১. “‘আল-কাফি’, খণ্ড ১, পৃঃ৫৪৩; মাজলিসি, মুহাম্মদ বাকের, ‘মিরআতে আল উকূল ফি শারহে আখবায়ে আল রসুল’, খণ্ড ৬, পৃঃ২৬৮, দারু কুতুবি ইসলামিয়া, তেহরান, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৪০৪ হি।”
১২. হযরত আলী (আ.)-র সততা ও ন্যায়ের বিষয় অনেক আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; উম্মে আইমান (রা.)-র বিষয়েও রয়েছে যে, মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন তিনি জান্নাতের أهل। (আল্লামা মাজলিসি, ‘বেহার আল আনওয়ার’, খণ্ড ১৭, পৃঃ৩৭৯, মোসসা আলওফা, বেইরুত, ১৪০৪ হি)।”
১৩. মুফীদ, মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ, ‘আলইখতিসাস’, পৃঃ১৮৩, আন্তর্জাতিক সম্মেলন আলফিয়া শাইখ মুফীদ, ক্বম, প্রথম মুদ্রণ, ১৪১৩ হি।



