জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

ধৈর্যের দীপ্তি, প্রজ্ঞার পথ: হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর আলোকিত আদর্শে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বর্ণনা

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: হযরত জয়নাব (সা.আ.)—এক মহীয়সী নারী, যিনি বন্দিত্বের শৃঙ্খলকে সত্যের মিম্বারে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাঁর ঈমান দুঃখের আগুনে পুষ্ট হয়েছিল, তাঁর প্রজ্ঞা সংকটের মাঝে পথ দেখিয়েছিল, আর তাঁর ভাষা সত্যের পক্ষে ছিল তীক্ষ্ণ তরবারির মতো।

ইসলামের ইতিহাসে তাঁর চরিত্র যে দীপ্তিময় ও অমর হয়ে আছে, তার মূল কারণ হলো—অসাধারণ ধৈর্য ও অটল প্রতিরোধের মনোভাব, যা তিনি বিপদের ঝড়েও ধরে রেখেছিলেন। শৈশব থেকেই তাঁর জীবন ছিল কঠিন পরীক্ষায় পূর্ণ। তিনি জন্মেছিলেন এমন এক ঘরে, যা ছিল আলোর, জ্ঞানের ও পবিত্রতার আধার—যেখানে তাঁর মা হযরত ফাতিমা (সা.আ.) ছিলেন পবিত্রতার প্রতীক, আর তাঁর পিতা হযরত আলী (আ.) ছিলেন ঈমান ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতিচ্ছবি।

এই কোমল হৃদয়ের শিশু, জীবনের শুরুতেই মায়ের নিপীড়ন ও শাহাদতের সাক্ষী হন। এরপর যৌবনে পিতার শাহাদতের শোক এবং ইমাম হাসান (আ.)-এর বিষমৃত্যুর যন্ত্রণা তাঁকে আরও দৃঢ় ও পরিণত করে তোলে। প্রতিটি বিপদ তাঁর আত্মাকে আরও শাণিত করে, তাঁর ঈমানকে আরও গভীর করে।

হযরত জয়নাব (সা.আ.) ছিলেন পাঞ্জতন আল-আবার শিক্ষায় গড়া এক আলোকিত আত্মা। এই মক্তব তাঁকে শিখিয়েছিল—আল্লাহর ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণ, গভীর বিশ্বাস, এবং অন্তর্দৃষ্টি। এই আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিই তাঁকে আশুরার মহৎ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত করে তোলে।

যখন অনেকেই শোকের ভারে ভেঙে পড়েছিলেন, তখন তিনি ধৈর্যের দীপ্তি হয়ে উঠেছিলেন। কষ্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি আল্লাহর প্রশংসায় মুখর হন। তাঁর ভাষণ—কুফা ও শামে—ছিল জাগরণ ও প্রতিবাদের দীপ্তি। তাঁর সাহস, অন্তর্দৃষ্টি ও ভাষার শক্তি এমন ছিল, যা কেবল কারবালার বার্তা বহন করেনি, বরং অত্যাচারের সিংহাসন কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

তিনি হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের সকল মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনন্য আদর্শ—যেখানে ঈমান, সাহসিকতা ও দায়িত্ববোধ একত্রে জ্বলে ওঠে।

হযরত জয়নাব (সা.আ.)—এক নারী, যিনি দুঃখের অতল থেকে ধৈর্যের মহাসাগর হয়ে উঠেছিলেন, যিনি অপমানের ছায়ায় থেকেও সম্মানের দীপ্তি হারাননি, যিনি দায়িত্বের ভারে নত হননি, বরং তা বহন করে নেতৃত্বের শিখরে পৌঁছেছিলেন।

বিপ্লবের নেতা বলেন: নারী হতে পারে ধৈর্য ও সহনশীলতার এক বিশাল মহাসাগর, হতে পারে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার এক উচ্চতম শিখর—এই সত্যকে হজরত জয়নাব (সা.আ.) নিজ জীবনে বাস্তব করে তুলেছেন।

একদিনের মধ্যেই তাঁর চোখের সামনে শাহাদত বরণ করেন তাঁর প্রিয়জনেরা—প্রায় ১৮ জন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন তাঁর ভাই, আল্লাহর প্রতিনিধি, ইমাম হুসাইন (আ.)। তিনি সহ্য করেন অপমান, এমন একজন নারী যিনি শৈশব থেকে সম্মান ও মর্যাদায় বেড়ে উঠেছেন, তাঁকে আমুয়ী সেনার দুর্বৃত্তরা অবমাননা করে, কিন্তু তিনি ভাঙেন না, নত হন না।

তিনি দায়িত্ব নেন—শোকাহত নারীদের, এতিম শিশুদের, আহত হৃদয়দের একত্রিত করে তাদের রক্ষা ও পরিচালনার। এই কঠিন সফরে তিনি ছিলেন তাদের আশ্রয়, তাদের অভিভাবক। তিনি ছিলেন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি, শান্তির প্রতিচ্ছবি। তিনি প্রমাণ করেন, নারীও পৌঁছাতে পারে আত্মিক শক্তির এমন উচ্চতায়, যেখানে ধৈর্যই হয় নেতৃত্বের ভিত্তি।

তিনি ছিলেন ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর সেবায় নিয়োজিত, যিনি নিজেও ছিলেন অসুস্থ ও শোকগ্রস্ত। এই সেবাও ছিল এক ধৈর্যের পরীক্ষা, যা তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হন।

আর যখন শত্রু তাঁকে তাঁর জীবনের বিপর্যয় নিয়ে তিরস্কার করে, তিনি বলেন: আমি কিছুই দেখিনি, শুধু সৌন্দর্য। যেখানে তাঁর ভাই, সন্তান, প্রিয়জনেরা রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন, তাঁদের মাথা বর্শার ডগায় তুলে নেওয়া হয়েছে—তবু তিনি বলেন, “সৌন্দর্য”। এই সৌন্দর্য কী?—এ সৌন্দর্য হলো ঈমানের, ত্যাগের, সত্যের পথে অটল থাকার সৌন্দর্য।

তবে হযরত জয়নাব (সা.আ.) শুধু ধৈর্যের প্রতীক নন, তিনি ছিলেন জ্ঞানের দীপ্তি, প্রজ্ঞার শিখর। তিনি ছিলেন এমন এক নেত্রী, যিনি বন্দিত্বের পথে ভাঙা হৃদয় ও ক্ষতবিক্ষত আত্মাকে ঈমানের ভাষায় সান্ত্বনা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন এমন এক বক্তা, যিনি অত্যাচারী শাসকদের সামনে দাঁড়িয়ে, যুক্তি ও কুরআনের আলোকে সত্যকে উন্মোচন করেছেন।

তাঁর জ্ঞান ও দূরদর্শিতা এত গভীর ছিল যে, ইতিহাস তাঁকে শুধু একজন শোকাহত নারী হিসেবে নয়, বরং একজন চিন্তাশীল, সাহসী ও প্রজ্ঞাবান আদর্শ নারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তিনি ছিলেন সেই নারী, যিনি বিপদের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ঈমান ও বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে হোসেইনীয় বার্তাকে চিরজীবী করে তুলেছেন।

কুফা ও শামে তাঁর ভাষণ ছিল কুরআনের যুক্তি ও আল্লাহর অন্তর্দৃষ্টিতে পূর্ণ। তিনি শত্রুকে স্তব্ধ করেছেন, ঘুমন্ত হৃদয়কে জাগিয়ে তুলেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন—জ্ঞান, সাহস ও নেতৃত্বের সমন্বয়ে নারীও হতে পারে সত্যের মিম্বর, এমনকি বন্দিত্বের শৃঙ্খল থেকেও।

হযরত জয়নাব (সা.আ.)—এক মহীয়সী নারী, যিনি প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও নেতৃত্বের এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, যা কেবল নবীদের জন্যই স্বাভাবিক। বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তাঁর সম্পর্কে বলেন:

এই নারী বন্দিত্বের পথে যে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের গবেষণার, চিন্তার, লেখার ও শিল্পসৃষ্টির বিষয় হওয়া উচিত। তিনি ছিলেন অহংকারী শাসকদের সামনে আত্মিক শক্তির প্রতীক। যখন ইবনে জিয়াদ তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিল—‘দেখলে, কী হলো? তোমরা তো পরাজিত!’—তিনি জবাব দেন: আমি কিছুই দেখিনি, শুধু সৌন্দর্য।’ এই এক বাক্যে তিনি সেই অহংকারী শাসকের মুখে আঘাত করেন।”

কারবালার পথে যাত্রার আগে, ইসলামের অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্ব—যাঁরা নিজেদের জ্ঞানী, সাহসী ও নেতা বলে দাবি করতেন—দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু হযরত জয়নাব (সা.আ.) বিভ্রান্ত হননি। তিনি বুঝেছিলেন, এই পথই সত্যের পথ, এবং তিনি তাঁর ইমামের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানতেন, এই পথ কষ্টের, তবু তিনি পা বাড়ান।

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের পর, যখন পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে যায়, হৃদয় ও আত্মা শোকের ভারে নুয়ে পড়ে, তখন এই নারী হয়ে ওঠেন এক আলোকবর্তিকা। তিনি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছান, যা ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মানবদের—নবীদের—উপযুক্ত।

হযরত জয়নাব (সা.আ.) ছিলেন সেই নারী, যিনি মক্তব-ই-ওহীর প্রকৃত শিক্ষায় গড়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের মুমিন, একজন আদর্শ শিয়া, যাঁর জীবন ছিল আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা, গভীর জ্ঞান, ধৈর্য ও সাহসিকতায় পরিপূর্ণ।

যে কেউ আহলে বাইতের প্রকৃত অনুসারীর বৈশিষ্ট্য জানতে চাইবে, তাকে হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর জীবন ও চরিত্রের দিকে তাকাতে হবে। তিনি ছিলেন সেই নারী, যাঁর ঈমান দুঃখে প্রস্ফুটিত হয়েছে, যাঁর বুদ্ধি সংকটে পথ দেখিয়েছে, এবং যাঁর ভাষা সত্যের পক্ষে ছিল তীক্ষ্ণ তরবারির মতো।

তিনি ছিলেন পূর্ণতা ও পরিপক্বতার প্রতিমূর্তি—আল্লাহর প্রতি দাসত্ব, জ্ঞানের দীপ্তি, ধৈর্যের দৃঢ়তা ও সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি। তিনি কেবল একজন নারী ছিলেন না, ছিলেন এক যোদ্ধা, এক পথপ্রদর্শক, যিনি কারবালার ছাই থেকে হোসেইনীয় বার্তাকে ইতিহাসের উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।

কারবালার রক্ত ও আগুনের মাঝে, তিনি ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পাশে—সহচর, সেবিকা ও নেতৃত্বের ভার বহনকারী। তাঁর জ্ঞান ছিল কেবল বাহ্যিক নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টিময়, আধ্যাত্মিক ও আল্লাহপ্রদত্ত। তিনি ছিলেন কুরআনের আয়াত ও তাফসিরে গভীরভাবে অভিজ্ঞ, তাঁর ভাষণ ছিল যুক্তি, প্রজ্ঞায় পূর্ণ, যা শত্রুকে স্তব্ধ করে এবং জনগণকে জাগিয়ে তোলে।

যদি কারবালাকে ঈমানের বিদ্যালয় বলা হয়, তবে হযরত জয়নাব (সা.) সেই বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষার্থী—যিনি হৃদয়ের রক্ত দিয়ে সত্যের পাঠ লিখেছেন, এবং প্রমাণ করেছেন, আহলে বাইতের প্রকৃত অনুসারী সেই, যিনি জিহাদ ও প্রচারে, ধৈর্য ও দূরদর্শিতায়, সর্বোপরি দায়িত্ববোধে অটল থাকেন।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button