জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

তোমার কোন কোন আমল আল্লাহর জন্য ছিল?

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহিরআমাদের জীবন, সময় এবং জ্ঞান—এগুলো মহান আল্লাহপ্রদত্ত এমন পুঁজি যা অসীম মূল্যবান। অথচ মানুষ কখনও কখনও এই মূল্যবান সম্পদকে এমন তুচ্ছ জিনিসের বিনিময়ে বিলিয়ে দেয়, যার কোনো মূল্যই নেই—বরং কখনও এই পুঁজি বিক্রি করে দেয় ভয়াবহ বিষের বিনিময়েও। এই কারণে প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের হিসাব করা উচিত: আমাদের কাজগুলো কি আসলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, নাকি দুনিয়ার লোভ, স্বার্থ এবং মানুষের দৃষ্টির জন্য?

বিশুদ্ধ নিয়ত বা ইখলাস এমন কোনো সহজলভ্য বিষয় নয় যে, হঠাৎ করে হৃদয়ে উদয় হলো এবং কাজ আলোকিত হয়ে গেল। এটির জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, মারেফাত, অন্তরের গভীর চিন্তন, এবং সেই চিন্তার ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া দিব্য আকর্ষণ।

যখন এই আকর্ষণ শক্তিশালী হয়, তখন এর বিরোধী বিষয়গুলোকে হৃদয় থেকে সরিয়ে দিতে হয়। তখনই একটি আমল ও কাজ হয়ে ওঠে প্রকৃত অর্থে খালেস, মূল্যবান এবং ইলাহি প্রিয়।

মরহুম আয়াতুল্লাহ মিসবাহ ইয়াজদি তাঁর এক নৈতিক পাঠে একটি গভীর প্রশ্ন সামনে তুলে ধরেছিলেন: “তোমার কোন আমল আল্লাহর জন্য ছিল?” এ প্রশ্নটি শুধু শ্রোতাদের জাগ্রত করার জন্য নয়; বরং প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষের আত্মাকে নাড়া দেওয়ার মতো এক আধ্যাত্মিক ঝাঁকুনি। তিনি সর্বপ্রথম কোরআনের এই বাণী স্মরণ করান—

وَاعلَمَوا اِنَّهُ لَیسَ لاَنفُسِکُم ثَمَنٌ دُون الجَنَّةُ

জেনে রাখো—তোমাদের প্রাণের প্রকৃত মূল্য জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়।

এরপর তিনি বলেন, এই যে আল্লাহ আমাদের যে মূল্যবান জীবন দিয়েছেন, আমরা অনেক সময় সেটিকে এমন একটি তুচ্ছ পাথরের সমান কিছুতে বিক্রি করে দিই। হায়! যদি অন্তত আমাদের কিছু কাজ শুধুই ওই তুচ্ছ বস্তুতে সীমিত থাকত! কিন্তু বাস্তবতা এর চেয়ে ভয়ংকর— অসংখ্যবার আমরা আমাদের জীবন, জ্ঞান ও পরিশ্রম—এসবকে বিক্রি করে দিই বিষাক্ত, ধ্বংসাত্মক লক্ষ্য ও কাজে, যার শেষফল আত্মিক ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নয়।

যদি আমরা আমাদের জ্ঞানকে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কাজে ব্যবহার করি, যদি আমাদের পরিশ্রম এমন ব্যক্তি বা কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে যাকে আল্লাহ অপছন্দ করেন— তাহলে আমরা শুধু তুচ্ছ বিনিময়ে তাকে বিক্রি করেছি তা-ই নয়, বরং নিজেকে আগুনে নিক্ষেপ করেছি, অথচ এখানেই আমাদের সেই সুযোগ ছিল; একই জ্ঞান, একই সময়, একই শক্তিকে এমন কাজে ব্যয় করার— যার সওয়াব সীমাহীন, অসীম, এবং যার হিসাব কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সীমাহীন পুরস্কার কি কখনো সীমিত মানদণ্ডে মাপা যায়?

আয়াতুল্লাহ মিসবাহ ইয়াজদি আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার দিকে আহ্বান জানিয়ে বলেন— আজ সকাল থেকে এখন পর্যন্ত তুমি যা যা করেছ, একটু মনোযোগ দিয়ে ভেবে দেখো। ধরো, তুমি দশটি “বড় কাজ” করেছ; প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি পদক্ষেপ হিসাবের আওতায়। এখন নিজের ভেতরে ফিরে তাকাও এবং সত্যকে স্বীকার করো— এই দশটির মধ্যে আসলে কতগুলো কাজ আল্লাহর জন্য ছিল?

কোন কাজটি এমন ছিল, যে কাজটি তুমি কখনও করতে না— যদি আল্লাহ তোমাকে আদেশ না দিতেন? এবং যখন আল্লাহ আদেশ দিলেন— তা যদি তোমার ক্ষতি, কষ্ট বা স্বার্থের বিরোধীও হয়— তুমি তবুও তা স্থিরচিত্তে গ্রহণ করেছ?

আমাদের কত মুহূর্ত এমন ছিল— যা আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির কোনো কাজে লাগাতে পারতাম— যার মূল্য অসীম, সীমাহীন, এবং আখেরাতের চিরস্থায়ী পুঁজি? কিন্তু নিয়ত এমন কোনো বিষয় নয় যে, তুমি বললে—“নিয়ত করছি”—এবং সঙ্গে সঙ্গে তা হাজির হয়ে গেল।

নিয়ত আসে চিন্তন থেকে, চিন্তন দেয় মারেফাত, মারেফাত তৈরি করে আল্লাহর প্রতি গভীর আকর্ষণ, আর এই আকর্ষণকে টিকিয়ে রাখতে হলে আল্লাহবিরোধী বিষয়গুলোকে হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে হয়। এ কারণেই বলা হয়— যদি তুমি তোমার সারাজীবন একজন মানুষকে পথ দেখানোর জন্য ব্যয় করো, এর মূল্য দুনিয়ার সব সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি। এগুলো কোনো অতিরঞ্জন নয়; এগুলো হলো কিয়ামতের দিনের কঠোর বাস্তবতা।

আমরা কখনো ভাবতে পারি— ইসলাম ও ধর্মের জন্য আমরা কত কিছু করেছি, কত সেবা দিয়েছি, কত কষ্ট করেছি। এবং তাই আমরা সওয়াবের অপেক্ষা করি। কিন্তু হিসাবের ময়দানে দেখা যেতে পারে— আমরা যেসব কাজ করেছিলাম কোনো দল, কোনো গোষ্ঠী বা দুনিয়ার স্বার্থে— তার মজুরি আমরা দুনিয়াতেই পেয়ে গেছি। “ওটা তুমি তোমার পেটের জন্য করেছিলে।”  সুতরাং আখেরাতে তার কোনো সওয়াব অবশিষ্ট নেই।

অতএব প্রশ্নটি আবারও সামনে দাঁড়ায়— তোমার কোন কোন আমল সত্যিই আল্লাহর জন্য ছিল? যদি কোনো আমল সত্যিই আল্লাহর জন্য হয়— তাহলে অধিক আয়, মানুষের প্রশংসা, সম্মান, খ্যাতি—এসব কিছুই আর তোমার অভিপ্রায়কে স্পর্শ করতে পারে না।  তখন তোমার প্রেরণা হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি, এবং তোমার লক্ষ্য হবে কেবল ইখলাস ও তোমার রব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button