
আলোচনা–২
দ্বিতীয় দলটির মতবাদ তৃতীয় দলের মতবাদ অপেক্ষা কিছুটা ভাল কিন্তু অপূর্ণাঙ্গ। তারা পবিত্র কোরআন বুঝতে হাদিসের সাহায্য নেয়, কিন্তু এটা ভুলে যায় যে হাদিসও কোরআনের মতোই নির্বাক (অর্থাৎ, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম)। হাদিস অবশ্যই কোরআনের ব্যাখ্যায় সহায়ক, তবে জীবন্ত ওস্তাদের মতো এটি হাতে-কলমে শিক্ষাদান করতে পারে না। পাঠককে নিজস্ব উপলব্ধি (perception) এর উপর নির্ভর করতে হয়।
এ দলের মতেও কোনো মানুষ নির্ভুল বা নিষ্পাপ নয়। ফলে কোরআনের ব্যাখ্যা সময়ের সাথে পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হতে থাকে। কোরআন ও হাদিস নামাজ বা রোজার বিধান দিয়ে থাকে কিন্তু নামাজ পড়িয়ে দেখাতে পারে না বা রোজা রেখে দেখাতে পারে না। তারা দাবি করে, “আমরা তাকলিদ করি না”, কিন্তু বাস্তবে তারা তাদের দলের শিক্ষিত ব্যক্তিদেরই অনুসরণ করে। আর এটাই তো তাকলিদ! তারা নিজেদের যুক্তির সমর্থনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিস উল্লেখ করে:
“আমি তোমাদের জন্য দুটি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি—কোরআন ও আমার সুন্নাহ।” কিন্তু সিহাহ সিত্তাহ (ছয়টি বিশুদ্ধ হাদিস সংকলন)-এ এমন কোনো হাদিস পাওয়া যায় না। শুধু মোয়াত্তা নামক হাদিস গ্রন্থে মরফু হাদিস হিসাবে এর উল্লেখ রয়েছে যার সনদগত দুর্বলতাও রয়েছে।
আলোচনা–৩
নবী করীম হযরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ নবী এবং পবিত্র কুরআন হলো সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ—যা পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনুসরণীয়। পৃথিবী যতদিন স্থায়ী হোক না কেন, মানবজাতিকে এই গ্রন্থ থেকেই নির্দেশনা ও জীবন-দর্শন গ্রহণ করতে হবে। এর পরে আর কোনো নতুন গ্রন্থ আসবে না।
এখন প্রশ্ন হলো: এই কুরআন থেকে পরিপূর্ণ হেদায়েত লাভ করার জন্য এর নির্ভুল ও অবিকল ব্যাখ্যাকারী কি বর্তমান থাকা আবশ্যক নয়?
যদি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর এমন কোনো ব্যক্তিত্ব (যারা নবী নন, তাদের কাছে ওহী আসে না, কিন্তু আল্লাহর বিশেষ মর্জিতে তারা কুরআনের গভীর ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম) না থাকে, তাহলে পবিত্র কুরআন তার প্রকৃত স্থান থেকে বিচ্যুত হবে। বিভিন্ন ব্যক্তি নিজেদের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেবে, এবং মানবজাতি পরিপূর্ণ হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হবে—যা আল্লাহর সুন্নতের পরিপন্থী।
এ বিষয়টি আলোচনা-১-এ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ কারণেই, উপরে উল্লিখিত ১নং দলের মতবাদ যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সর্বাধিক সঠিক। তারা পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যার জন্য প্রত্যক্ষ বা জীবন্ত ওস্তাদ (Living Agent) হিসেবে নবী (সা.)-এর আহলে বাইত-কে অনুসরণ করে। এটি সিহাহ সিত্তাহ-এর একাধিক হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তারা নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের সদস্যদেরকে পবিত্র কুরআনের আয়াত (যেমন—৩৩:৩৩, ৩:৬১) এবং হাদিসের আলোকে পবিত্র ও নিষ্পাপ বলে বিশ্বাস করে। ফলে তাদের মতে, কুরআনের ব্যাখ্যা কখনই বিকৃত হবে না।
কুরআন ও আহলে বাইতের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক সম্পর্কে একটি হাদিস উল্লেখ করা যাক:
যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আমি তোমাদের মধ্যে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা তোমরা যদি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর, তাহলে কখনই পথভ্রষ্ট হবে না:
১. আল্লাহর কিতাব (কুরআন)—যা আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত প্রসারিত সত্য।
২. আমার আহলে বাইত (পরিবার)।
এ দুটি কখনও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না কাওসার নামক ঝর্ণায় আমার সাথে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত।
সুতরাং, সতর্ক থাকো—আমার পরে এ দুটির সাথে তোমরা কী আচরণ করো!”
(সূত্র: জামে আত-তিরমিযী, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা নং ৩৬০, হাদিস নং ৩৭২৬, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ- অক্টোবর ১৯৯৮)
সিদ্ধান্ত:
এখন, কোন মতবাদ সঠিক এবং আপনি কোনটিকে আন্তরিকভাবে অনুসরণ করবেন—তা সম্পূর্ণরূপে আপনার নিজস্ব বিবেচনার উপর নির্ভর করে।
বিনীত
কৃষিবিদ শেখ মোঃ শহীদুজ্জামান অধ্যক্ষ (অবসরপ্রাপ্ত)
(বিসিএস কৃষি) কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট দৌলতপুর, খুলনা
মিডিয়া মিহির/ধর্ম ও বিশ্বাস