ধর্ম ও বিশ্বাস

জীবন্ত শিক্ষকের আবশ্যকতা

মিডিয়া মিহির | প্রকাশঃ ১০ জুন ২০২৫

জীবন্ত শিক্ষকের আবশ্যকতা

জীবন্ত শিক্ষকের আবশ্যকতা সম্পর্কে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীনে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে অবস্থিত সার্ডিতে (কেন্দ্রীয় সম্প্রসারণ সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউট=CERDI) মরহুম ড. মতিউর রহমান (সাবেক উপপরিচালক, প্রশিক্ষণ) সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। Perception বা উপলব্ধির ক্ষমতা যে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়, তা বোঝাতে তিনি নিচের বাস্তব উদাহরণটি তুলে ধরেছিলেন।

উপস্থাপনাটি এমন ছিল:

ওভারহেড প্রজেক্টরে তিনটি স্লাইডে একটি করে প্রাণীর ছবি দেখানো হলো। প্রশিক্ষণার্থীদের জিজ্ঞাসা করা হল-  তিনটি ছবি একই প্রাণীর কিনা। প্রশিক্ষণার্থীরা দেখল তিনটি ছবির মধ্যে কোনো মিল নেই। তিনি বলেছিলেন, ছবি তিনটি আফ্রিকার একটি বিরল প্রাণীর কাল্পনিক চিত্র। এই অচেনা প্রাণীর ছবি আঁকার জন্য দেশের তিনজন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পীকে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (Encyclopedia Britainica) থেকে প্রাণীটির একটি বর্ণনা (লেখচিত্র) সরবরাহ করা হয়েছিল। যেহেতু প্রাণীটি তিনজনের কাছেই অপরিচিত ছিল, তাই তারা দেওয়া বর্ণনার ভিত্তিতে নিজ নিজ উপলব্ধি অনুযায়ী ছবি এঁকেছিলেন। কারও কাছে যেহেতু প্রাণীটির সঠিক ধারণা ছিল না, তাই তিনজনের ছবি তিন রকম হয়েছিল। এরপর প্রশিক্ষণ ক্লাসের উপসংহারে তিনি বলেছিলেন, সবার উপলব্ধি করার ক্ষমতা একরকম বা সমান নয়। তাই শুধু বই পড়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। বই-পত্র পরোক্ষ সহায়ক হিসাবে কাজ করলেও, পরিপূর্ণ শিক্ষার জন্য প্রত্যক্ষ ও প্রাণবন্ত শিক্ষক বা ওস্তাদের প্রয়োজন।

তিনি আরও উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, বাচ্চারা যখন মায়ের কাছে বসে ডিমের ছবি আঁকতে গিয়ে গোল আলু বা অন্য কিছু এঁকে ফেলে, তখন মা বাচ্চার হাত ধরে ধরে দেখিয়ে দেন বা শিখিয়ে দেন যে, এটা এমন হবে, ওটা অমন হবে। আর এ জন্যই এত পরিশ্রম ও অর্থ খরচ করে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।

নিচের অংশটি আমার আলোচনা:

এখন আসুন, আমাদের বাস্তব জীবনে এর একটি যথার্থ প্রয়োগ দেখে নিই। মুসলমানদের মধ্যে মোটা দাগে তিনটি দল দেখা যায়:  প্রথম দলটি রসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর দু’টি জিনিস কুরআরন ও  তাঁর পরিবার বা আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরার কথা বলে। দ্বিতীয় দলটি কোরআনের পাশাপাশি সুন্নাহ বা হাদিসকে গুরুত্ব দেয়। তৃতীয় দলটি শুধুমাত্র কোরআনকেই যথেষ্ট মনে করে।

কোনো ব্যক্তি এই দলগুলোর যেকোনোটির সাথে যুক্ত হলেই ইসলাম সম্পর্কে কিছু না কিছু ধারণা লাভ করতে পারে। তবে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ বোঝার ক্ষেত্রে প্রতিটি দলের উপলব্ধির মধ্যে পার্থক্য রয়ে যায়। বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা উভয়ই এই সত্যকে সমর্থন করে।

আলোচনা–১:
তৃতীয় ধারাটি আধুনিক কালে বেশি প্রচারিত হচ্ছে এবং শুনতে আপাতদৃষ্টিতে বেশি যুক্তিসঙ্গত মনে হলেও এটাই সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর। এ দলের মতে- ”হাদিসের মধ্যে অনেক দ্বিমুখীতা বা বিভ্রান্তিকর বর্ণনা দেখা যায়, তাই হাদিস বাদ দাও এবং কোরআন নির্ভুল, সুতরাং আল্লাহর কোরআনই যথেষ্ট”। এ মতের মধ্যে বিভ্রান্তি সবচেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে ড. মতিউর রহমান স্যারের উপস্থাপনাটিই যথেষ্ট। এ দলের লোকদের মতে, নবী (সা.)-এর পর কোনো মানুষ নির্ভুল বা নিষ্পাপ নয়। পবিত্র কোরআনে সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি (প্রায়শ বলা হয় ৬,৬৬৬টি) আয়াত রয়েছে। যেহেতু কোনো মানুষ নির্ভুল বা নিষ্পাপ নয়, সে যদি হাজারেও একটি ভুল করে, তাহলে সে ৬টি আয়াতের বেশি ভুল করে ফেলবে। প্রত্যেকের ভুলের randomization (অর্থাৎ এলোমেলো ভাব) ভিন্ন হবে। ফলে পবিত্র কোরআন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় মানবজাতির কল্যাণ সাধনে সক্ষম হবে না। যে বা যারা এ মত প্রচার করছে, তারা বাস্তবে কোরআন বুঝতে অন্যকে অনুসরণ করছে। এটাই তাদের দ্বিমুখীতার প্রমাণ—তারা হাদিস মানে না, অথচ অন্যের ব্যাখ্যাকেই অনুসরণ করে! এদের অনেকেই কোরআন বোঝার জন্য অনুবাদের উপর নির্ভরশীল।

এদের বড় বিভ্রান্তি আরেকটি জায়গায়। তারা বলে, “পৃথিবীতে কোরআন একটাই, তাই এটাই যথেষ্ট”। এ কথাটি শুধুমাত্র আরবি কোরআনের মূল টেক্সটের ক্ষেত্রে সত্য। কিন্তু অনুবাদ বা তাফসীরের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়, কারণ অনুবাদ একাধিক এবং ব্যাখ্যাকারীর সংখ্যাও একজনের বেশি। ফলে এদের দলে নিত্যনতুন মতবাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে।

আলোচনা–২

দ্বিতীয় দলটির মতবাদ তৃতীয় দলের মতবাদ অপেক্ষা কিছুটা ভাল কিন্তু অপূর্ণাঙ্গ। তারা পবিত্র কোরআন বুঝতে হাদিসের সাহায্য নেয়, কিন্তু এটা ভুলে যায় যে হাদিসও কোরআনের মতোই নির্বাক (অর্থাৎ, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম)। হাদিস অবশ্যই কোরআনের ব্যাখ্যায় সহায়ক, তবে জীবন্ত ওস্তাদের মতো এটি হাতে-কলমে শিক্ষাদান করতে পারে না। পাঠককে নিজস্ব উপলব্ধি (perception) এর উপর নির্ভর করতে হয়।

এ দলের মতেও কোনো মানুষ নির্ভুল বা নিষ্পাপ নয়। ফলে কোরআনের ব্যাখ্যা সময়ের সাথে পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হতে থাকে। কোরআন ও হাদিস নামাজ বা রোজার বিধান দিয়ে থাকে কিন্তু  নামাজ পড়িয়ে দেখাতে পারে না বা রোজা রেখে দেখাতে পারে না। তারা দাবি করে, “আমরা তাকলিদ করি না”, কিন্তু বাস্তবে তারা তাদের দলের শিক্ষিত ব্যক্তিদেরই অনুসরণ করে। আর এটাই তো তাকলিদ! তারা নিজেদের যুক্তির সমর্থনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিস উল্লেখ করে:

“আমি তোমাদের জন্য দুটি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি—কোরআন ও আমার সুন্নাহ।” কিন্তু সিহাহ সিত্তাহ (ছয়টি বিশুদ্ধ হাদিস সংকলন)-এ এমন কোনো হাদিস পাওয়া যায় না। শুধু মোয়াত্তা নামক হাদিস গ্রন্থে মরফু হাদিস হিসাবে এর উল্লেখ রয়েছে যার সনদগত দুর্বলতাও রয়েছে।

আলোচনা–৩

নবী করীম হযরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ নবী এবং পবিত্র কুরআন হলো সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ—যা পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনুসরণীয়। পৃথিবী যতদিন স্থায়ী হোক না কেন, মানবজাতিকে এই গ্রন্থ থেকেই নির্দেশনা ও জীবন-দর্শন গ্রহণ করতে হবে। এর পরে আর কোনো নতুন গ্রন্থ আসবে না।

এখন প্রশ্ন হলো: এই কুরআন থেকে পরিপূর্ণ হেদায়েত লাভ করার জন্য এর নির্ভুল ও অবিকল ব্যাখ্যাকারী কি বর্তমান থাকা আবশ্যক নয়?

যদি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর এমন কোনো ব্যক্তিত্ব (যারা নবী নন, তাদের কাছে ওহী আসে না, কিন্তু আল্লাহর বিশেষ মর্জিতে তারা কুরআনের গভীর ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম) না থাকে, তাহলে পবিত্র কুরআন তার প্রকৃত স্থান থেকে বিচ্যুত হবে। বিভিন্ন ব্যক্তি নিজেদের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেবে, এবং মানবজাতি পরিপূর্ণ হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হবে—যা আল্লাহর সুন্নতের পরিপন্থী।

এ বিষয়টি আলোচনা-১-এ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ কারণেই, উপরে উল্লিখিত ১নং দলের মতবাদ যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সর্বাধিক সঠিক। তারা পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যার জন্য প্রত্যক্ষ বা জীবন্ত ওস্তাদ (Living Agent) হিসেবে নবী (সা.)-এর আহলে বাইত-কে অনুসরণ করে। এটি সিহাহ সিত্তাহ-এর একাধিক হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তারা নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের সদস্যদেরকে পবিত্র কুরআনের আয়াত (যেমন—৩৩:৩৩, ৩:৬১) এবং হাদিসের আলোকে পবিত্র ও নিষ্পাপ বলে বিশ্বাস করে। ফলে তাদের মতে, কুরআনের ব্যাখ্যা কখনই বিকৃত হবে না।

কুরআন ও আহলে বাইতের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক সম্পর্কে একটি হাদিস উল্লেখ করা যাক:

যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আমি তোমাদের মধ্যে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা তোমরা যদি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর, তাহলে কখনই পথভ্রষ্ট হবে না:
১. আল্লাহর কিতাব (কুরআন)—যা আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত প্রসারিত সত্য।
২. আমার আহলে বাইত (পরিবার)।
এ দুটি কখনও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না কাওসার নামক ঝর্ণায় আমার সাথে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত।
সুতরাং, সতর্ক থাকো—আমার পরে এ দুটির সাথে তোমরা কী আচরণ করো!”
(সূত্র: জামে আত-তিরমিযী, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা নং ৩৬০, হাদিস নং ৩৭২৬, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ- অক্টোবর ১৯৯৮)

সিদ্ধান্ত:

এখন, কোন মতবাদ সঠিক এবং আপনি কোনটিকে আন্তরিকভাবে অনুসরণ করবেন—তা সম্পূর্ণরূপে আপনার নিজস্ব বিবেচনার উপর নির্ভর করে।

বিনীত

কৃষিবিদ শেখ মোঃ শহীদুজ্জামান অধ্যক্ষ (অবসরপ্রাপ্ত)

(বিসিএস কৃষি) কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট দৌলতপুর, খুলনা

মিডিয়া মিহির/ধর্ম ও বিশ্বাস

আরো পড়ুন..

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button