কুরআনজীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্বহাদিস

জাহান্নাম ও জান্নাত কি ইতিমধ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৩ নভেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলামী দর্শনে জান্নাত ও জাহান্নাম কেবল পুরস্কার ও শাস্তির স্থান নয়; বরং বস্তুজগৎ ও আধ্যাত্মিক জগতের সংযোগের এক গভীর প্রতীক। এই ধারণা ঈমান, ন্যায়বিচার এবং পরকালের বাস্তবতা নিয়ে এক প্রাচীন ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে: জান্নাত ও জাহান্নাম কি ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে, নাকি কিয়ামতের পর সৃষ্টি হবে?

১. বিতর্কের সূচনা

ইসলামী কালাম (ধর্মতত্ত্ব)–এর ইতিহাসে জান্নাত ও জাহান্নামের সৃষ্টি সম্পর্কে দুটি মত পাওয়া যায়—

১- একদল আলেম বলেন, জান্নাত ও জাহান্নাম এখনই সৃষ্ট এবং বিদ্যমান।
২- অপর দল বলেন, এগুলো এখনো সৃষ্টি হয়নি; বরং কিয়ামতের পর সৃষ্টি হবে।

২. প্রথম মত: জান্নাত ও জাহান্নাম ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে

ইমামিয়া (শিয়া) ও আশআরিয়া (সুন্নি) আলেমদের বৃহৎ অংশের বিশ্বাস—জান্নাত ও জাহান্নাম এখনই অস্তিত্বশীল। তাদের যুক্তি কুরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে স্পষ্টভাবে সমর্থিত।

 কুরআনের প্রমাণসমূহ

(১)

وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِين
(সূরা আলে-ইমরান, ৩:১৩৩)

তোমরা তোমাদের প্রভুর ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে দ্রুত অগ্রসর হও, যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের সমান — যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

এখানে ব্যবহৃত শব্দ “أُعِدَّتْ” (উ’ইদ্দাত) — অতীত কাল, অর্থাৎ “প্রস্তুত করা হয়েছে”; এটি বর্তমান অস্তিত্বের ইঙ্গিত।

(২)

وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ
(সূরা আল-বাকারা, ২:২৪)
“সতর্ক থাকো সেই অগ্নি থেকে, যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এই আয়াতও বর্তমান কালের প্রস্তুত অবস্থা নির্দেশ করে।

(৩)

عِندَهُ جَنَّاتُ الْمَأْوَىٰ
(সূরা আন্-নাজম, ৫৫)
তাঁর নিকট রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া (চিরনিবাসের উদ্যান)। এখানেও “রয়েছে” শব্দটি বর্তমান অস্তিত্ব বোঝায়।

হাদীসের প্রমাণ

শায়খ সাদূক তাঁর গ্রন্থ আত্‌তাওহিদ-এ বর্ণনা করেন, আবু সালত হিরাওয়ি বলেন:

আমি ইমাম রেযা (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম — হে রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর পুত্র! জান্নাত ও জাহান্নাম কি এখনই বিদ্যমান? ইমাম উত্তর দিলেন:
«نَعَمْ، دَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ الْجَنَّةَ، وَ رَأَى النَّارَ حِينَ عُرِجَ بِهِ.»
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। রাসূলুল্লাহ ﷺ মিরাজের রাতে জান্নাতে প্রবেশ করেছিলেন এবং জাহান্নাম দেখেছিলেন। আমি বললাম, “কিছু মানুষ বলে, জান্নাত ও জাহান্নাম এখনো সৃষ্টি হয়নি। ইমাম রেযা (আ.) বললেন:

«لَيْسُوا مِنَّا وَ لَا نَحْنُ مِنْهُمْ؛ مَنْ أَنْكَرَ خَلْقَ الْجَنَّةِ وَ النَّارِ فَقَدْ كَذَّبَ النَّبِيَّ ﷺ، وَ لَيْسَ لَهُ فِي وَلَايَتِنَا نَصِيبٌ.»
তারা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, আমরাও তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। যে জান্নাত ও জাহান্নামের সৃষ্টিকে অস্বীকার করে, সে নবী ﷺ–কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং আমাদের ওয়ালায়াত থেকে বঞ্চিত হয়। একইভাবে, ইমাম সাদিক (আ.) বর্ণনা করেন, নবী করিম ﷺ বলেছেন:

«يَا عَلِيّ! إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ الْجَنَّةَ مِنْ طُوبَى وَ فِضَّةٍ، وَ أَقْسَمَ بِعِزَّتِهِ أَنْ لَا يَدْخُلَهَا شَرَّابٌ وَ لَا نَوَّامٌ وَ لَا دَيُّوثٌ.»
হে আলী! আল্লাহ জান্নাত সৃষ্টি করেছেন স্বর্ণ ও রৌপ্যের ইটে; এবং শপথ করেছেন, কোনো মদ্যপায়ী, অতিনিদ্রাগ্রস্ত বা নৈতিক অধঃপতিত ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না।

৩. অবস্থান সম্পর্কে মতভেদ

জান্নাত ও জাহান্নাম কোথায় অবস্থিত — এ নিয়েও দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে:

(ক) এগুলো এই মহাবিশ্বেরই অদৃশ্য স্তরে অবস্থিত; চোখে দেখা যায় না, কিন্তু “বাসিরাত” (অন্তর্দৃষ্টি) দ্বারা উপলব্ধি করা যায়।

(খ) এগুলো এই পৃথিবীকে পরিবেষ্টন করে আছে; পৃথিবী তাদের ভেতরে এক ক্ষুদ্র পরিসর—যেমন ভ্রূণ মাতৃজঠরে। এ জন্য কুরআনে বলা হয়েছে—

عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ
(সূরা হাদীদ, ৫৭:২১)
এর প্রশস্ততা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমান। এটি মানুষের বোধগম্যতার উপযোগী এক উপমা।

৪. দ্বিতীয় মত: জান্নাত ও জাহান্নাম এখনো সৃষ্টি হয়নি

কিছু মু’তাযিলি ও সাইয়্যেদ মুরতজা প্রমুখ আলেমের মত— জান্নাত ও জাহান্নাম এখনো সৃষ্টি হয়নি; বরং কিয়ামতের পর সৃষ্টি হবে।

তাদের যুক্তি দুটি বিষয় নির্ভর—

১- কিয়ামতের সময় যখন বিশ্বজগত ধ্বংস হবে, তখন যদি জান্নাত ও জাহান্নাম ইতিমধ্যেই সৃষ্টি থাকে, তবে তারাও ধ্বংস হয়ে যাবে—যা স্থায়ী জান্নাতের ধারণার বিপরীত।
২- মানুষের বিচার শুরু হওয়ার আগেই জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্বের কোনো কার্যকর ফল নেই।

৫. এই মতের খণ্ডন

কুরআনে আল্লাহ বলেন:

كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ
(সূরা কাসাস, ২৮:৮৮)
সব কিছুই বিনষ্ট হবে, কেবল তাঁর সত্তা ব্যতীত।

এখানে ‘হালিক’ (ধ্বংস) শব্দটি অস্তিত্ব বিলোপ নয়; বরং দুনিয়ার কার্যকারিতা শেষ হওয়া বোঝায়। মানুষের মৃত্যুর পর যেমন তার চেতনা অন্য জগতে স্থানান্তরিত হয়, তেমনি কিয়ামতের ধ্বংসও জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্বকে নস্যাৎ করে না, বরং এক নতুন স্তরে নিয়ে যায়।

ইসলামী আলেমদের ঐকমত্য অনুযায়ী—আল্লাহ জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন, এবং সেগুলো চিরন্তন। ফানাশীলতা (ধ্বংস) এই পার্থিব জগতের বৈশিষ্ট্য, জান্নাত ও জাহান্নামের নয়।

সুতারাং জান্নাত ও জাহান্নামের ধারণা ইসলামে কেবল শাস্তি ও পুরস্কারের প্রতীক নয়; বরং তা ঈমান, ন্যায়বিচার ও পরকালীন বাস্তবতার জীবন্ত প্রতিফলন।
বেশিরভাগ ইসলামী আলেমের মতে, জান্নাত ও জাহান্নাম ইতিমধ্যেই সৃষ্টি ও বিদ্যমান; তবে তাদের পূর্ণতা প্রকাশ পাবে কিয়ামতের পর, মানুষের আমল ও নিয়তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। অতএব, জান্নাত ও জাহান্নাম কোনো ভবিষ্যৎ কল্পনা নয়— বরং এক অনন্ত বাস্তবতা,যার চাবি আমরা প্রতিদিন আমাদের কাজ ও কথা দিয়ে তৈরি করছি।

পাদটীকা

 ১. জান্নাত মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৩৩

২.সতর্ক থাকো সেই আগুন থেকে, যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৩১

৩.আর তাঁর নিকট রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া (চিরনিবাসের উদ্যান)। সূরা আন্-নাজম, (৫৩), আয়াত ১৫ এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ রয়েছে: সূরা হাদীদ (৫৭:২১), সূরা তাওবা (৯:৮৯ ও ১০০), সূরা আল-বাকারা (২:২৪)।

৪.শায়খ সাদূক, আত্‌তাওহিদ, পৃষ্ঠা ১১৮, প্রকাশনা: জামিয়া মুদাররিসিন, কোম, ১৩৮৭ হিজরি ক্যালেন্ডার।

৫.শায়খ হুর আমেলি, ওয়াসায়েলুশ্ শিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩২৮ (প্রকাশনা: আহলুল বায়ত ইনস্টিটিউট, কোম) এবং খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ২৪৮ (প্রকাশনা: দার ইহইয়াউত তুরাস আল-আরাবি, বৈরুত)।

৬.আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নমুনা, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৯৮, প্রকাশনা: দারুল কুতুবুল ইসলামিয়া।

৭.কখনোই না! যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানে জানতে, তবে অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে।সূরা তাকাসুর (১০২), আয়াত ৫-৬

৮. শায়খ মুফিদ, আওয়াইলুল মাকালাত, পৃষ্ঠা ২২০।

৯. (একই আয়াত পুনরুক্তি): সূরা তাকাসুর (১০২), আয়াত ৫-৬।

১০.এর প্রশস্ততা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমান। সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ২১

১১. আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নমুনা, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৯৫।

১২. সব কিছুই বিনষ্ট হবে, কেবল তাঁর সত্তা ব্যতীত। সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮৮

১৩.এর ফলফল ও ছায়া চিরস্থায়ী। সূরা রা‘দ (১৩), আয়াত ৩৫

১৪.সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮৮ (পূর্বোক্ত আয়াত পুনরায় উল্লেখিত)।

১৫. শরহে তাজরীদ (গবেষণা: জানজানি), পৃষ্ঠা ৪৫৩, প্রকাশনা: শাকুরি পাবলিকেশনস।

১৬. শায়খ মুফিদ, আওয়াইলুল মাকালাত, পৃষ্ঠা ২২০–২২১।

১৭. আয়াতুল্লাহ সুবহানি, মুহাদারাত ফিল ইলাহিয়্যাত, পৃষ্ঠা ৪৭২, প্রকাশনা: ইমাম সাদিক (আ.) ইনস্টিটিউট।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button