বিশ্ববিশেষ সংবাদসংবাদ বিশ্লেষণ

জাতিসংঘে সম্মেলনে নেতানিয়াহুর আটটি প্রকাশ্য ও হাস্যকর মিথ্যাচার

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ:২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অবৈধ দখলদার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বক্তৃতা গাজা উপত্যকার সরকারি তথ্য কার্যালয়ের কঠোর প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। গাজার সংস্থা অভিযোগ করেছে, নেতানিয়াহু আটটি বড় মিথ্যা ও ডজন ডজন ভুয়া দাবি তুলে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা তার বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে।

গাজার এই রাষ্ট্রীয় সংস্থা নেতানিয়াহুর মিথ্যাগুলোকে নিম্নরূপ ব্যাখ্যা করেছে:

১. গাজায় আটক ইসরায়েলি আটকাদের ভুলে না যাওয়ার দাবি: নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা স্পষ্টতই নিজস্ব ফ্যাসিবাদী মন্ত্রীদের গণহত্যা, সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং গাজার মানুষের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি নীতিমালা বাস্তবায়নে তৎপর, এবং তারা ইসরায়েলি বন্দীদের ভাগ্য সম্পর্কে কোনো মনোযোগ দেয় না।

২. ৭ অক্টোবর ২০২৩–এর পর ইসরায়েলের প্রতি বৈশ্বিক সমর্থনের মিথ্যা:
নেতানিয়াহু দাবি করেছেন যে বিশ্বনেতারা তাকে ও ইসরায়েলকে সমর্থন করেন, অথচ বাস্তবে এই সমর্থন সম্পূর্ণভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং আজ অধিকাংশ দেশই ইহুদি রাষ্ট্রের অপরাধকে নিন্দা করছে ও তাদের বর্ণনার সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

৩. বিশ্ব জনমতকে খাটো করে দেখা: নেতানিয়াহু দাবি করেছেন যে বিশ্বনেতারা কথিতভাবে ‘উগ্র ইসলামপন্থীদের’ চাপে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন, কিন্তু সবাই জানে বাস্তবতা হলো বিশ্ব জনমত অতীতের ভুল সংশোধন করছে এবং ফিলিস্তিনি জাতির অধিকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।

৪. সাতটি ফ্রন্টে যুদ্ধ সম্পর্কে মিথ্যাচার: নেতানিয়াহু এসব যুদ্ধকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই’ বলে বর্ণনা করেছেন, অথচ বাস্তবে এই যুদ্ধগুলো বেসামরিক মানুষ ও অসামরিক অবকাঠামোর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিশ্চিত করেছে যে নিহতদের ৯৪ শতাংশই বেসামরিক, যার মধ্যে ৩০ হাজারেরও বেশি নারী ও শিশু রয়েছে, এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামোগত খাতের ৯০ শতাংশেরও অধিক অংশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে।

৫.গাজার জনগণকে বের হতে বাধা দেওয়া নিয়ে মিথ্যাচার: নেতানিয়াহু দাবি করেছেন যে প্রতিরোধগোষ্ঠীগুলো মানুষকে গাজা ত্যাগ করতে বাধা দিচ্ছে। অথচ নিজে তিনি প্রকাশ্যে ৭ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতির কথা বলেছেন এবং গাজার স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বহুবার জানিয়েছে যে তারা শরণার্থীদের সাহায্য করেছে এবং কাউকে বের হওয়া থেকে বিরত রাখেনি।

৬.বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু না করার বিষয়ে মিথ্যা: নেতানিয়াহু দাবি করেছেন যে যেহেতু তিনি আগে গাজার মানুষকে অঞ্চল ছাড়তে বলেছেন, তাই গণহত্যার কোনো উদ্দেশ্য নেই। অথচ দখলদার শাসনের সেনাবাহিনী ২ লাখ টনেরও বেশি বোমা আবাসিক এলাকায় নিক্ষেপ করেছে এবং ৬৪ হাজারেরও বেশি বেসামরিক মানুষকে শহীদ করেছে, যার মধ্যে ২০ হাজার শিশু এবং ১০ হাজার ৫০০ নারী অন্তর্ভুক্ত। হাজার হাজার পরিবারসহ তাদের নামও জননিবন্ধন থেকে মুছে গেছে।

৭.সহায়তা লুটের অভিযোগে প্রতিরোধের বিরুদ্ধে অপবাদ: নেতানিয়াহু দাবি করেছেন যে প্রতিরোধগোষ্ঠীগুলো গাজায় মানবিক সহায়তা লুট করছে। অথচ বাস্তবে দখলদার শাসন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দিয়ে গাজায় অনাহার আর খাদ্য অবরোধের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে ১৪৭ শিশুসহ শত শত বেসামরিক মানুষ ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনী ‘মৃত্যু ফাঁদ’ স্থাপন করে শত শত ক্ষুধার্ত বাস্তুচ্যুতকে হত্যা, আহত বা আটক করেছে।

৮.বিশ্বে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে বিকৃতি: নেতানিয়াহু দাবি করেছেন যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে ইহুদি হত্যাকে উসকে দেওয়া; অথচ বাস্তবতা হলো—ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া অতীতের অপরাধ সংশোধন এবং ৭৭ বছরের দখল ও নিপীড়নের পর ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার এক বিলম্বিত প্রচেষ্টা।

এরপর গাজা উপত্যকার সরকারি তথ্য কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে: জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর ভাষণ ছিল সত্য বিকৃতি ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার দায় থেকে পলায়নের এক ব্যর্থ চেষ্টা।

গাজার এই সরকারি সংস্থা জোর দিয়ে বলেছে: এসব মিথ্যাচার বাস্তবতা বদলাতে পারবে না। আজ বিশ্ব আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে যে ইসরায়েলি দখলদার শাসন একটি উপনিবেশবাদী, প্রতারণা, সহিংসতা ও সংগঠিত হত্যার ওপর দাঁড়ানো ভুয়া শাসনব্যবস্থা।

বিবৃতির শেষে গাজার সরকারি তথ্য কার্যালয় উল্লেখ করেছে যে দখলদার ইসরায়েলি শাসন ও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি গাজার মানবিক বিপর্যয়ের দায়ভার বহন করে। তারা তাৎক্ষণিকভাবে গণহত্যা ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ, দখলদার বাহিনীর গাজা থেকে প্রত্যাহার, মানবিক সহায়তা প্রবেশের জন্য করিডোর খোলা, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে দ্রুত স্বীকৃতি এবং এই ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ দখলদারিত্বের অবসান দাবি করেছে।

গতকাল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নেতানিয়াহুর বক্তৃতা শুরু হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শতাধিক প্রতিনিধি নিন্দার স্লোগান দিতে দিতে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন।

এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা নিজেদের দেশে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর উপস্থিতির প্রতিবাদে জাতিসংঘ ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন—যেখানে এই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ওয়ারেন্টভুক্ত যুদ্ধাপরাধী ভাষণ দিচ্ছিল। তারা গাজার প্রতি তাদের দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।

প্রদর্শনকারী অংশগ্রহণকারীরা গাজার প্রতি সমর্থনের কথা জোর দিয়ে পুনরায় উল্লেখ করে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর ধারাবাহিক অপরাধের নিন্দা জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভকারীরা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভিত্তিতে নেতানিয়াহুকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গ্রেফতারের দাবি জানান।

 আরও পড়ুন 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button