চিৎকার-চেঁচামেচি আর তিরস্কার দিয়ে কখনো শিশু গড়া যায় না
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: শিশুর ভুল সংশোধনের নামে বারবার চেঁচামেচি নয়, প্রয়োজন কোমল স্পর্শ, সহানুভূতি আর দক্ষতার শিক্ষা। ঘরের বাতাস যখন উত্তেজনায় ভারী হয়ে ওঠে, তখন শান্ত, স্নিগ্ধ ও সুশৃঙ্খল কথার জাদুতেই ফিরে আসে শান্তি এবং শিশু গড়ে ওঠে সুন্দর মানুষ।
যে ঘরে সন্তানের প্রতি পদে পদে শুধু তিরস্কার আর কণ্ঠস্বর উঁচু হয়, সে ঘরের দেওয়ালগুলো যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়। বাতাসে থমথমে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, আর শিশুর মনের আয়নায় পড়ে একের পর এক আঘাতের দাগ। এ পথ ভুল পথ। সঠিক পথ সেই, যেখানে ভুলের মধ্যেও শিশু খুঁজে পায় মায়া, যেখানে শাসনের বদলে শেখানো হয় দক্ষতা, আর তিরস্কারের ঝড়ের পরিবর্তে বয়ে যায় সহমর্মিতার মৃদু হাওয়া।
হুজ্জাতুল ইসলাম আলীরেজা তারাশিওন, পরিবার ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রখ্যাত পরামর্শক, এক তরুণ মায়ের প্রশ্নের উত্তরে এমনই আলোর দিশা দেখিয়েছেন। প্রশ্নটি ছিল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া:
আমার স্বামী আমাদের আট বছরের ছেলেকে প্রায়ই বকাঝকা করেন। ছোট্ট ভুলও তাঁর চোখ এড়ায় না। আমি যতবারই বলি, এভাবে হয় না, তিনি শোনেন না। স্বভাবে তিনি রাগী, খুঁতখুঁতে, একটু অন্তর্মুখীও। আমি এখন কী করব?
তারাশিওন সাহেব মৃদু হেসে বললেন, “অধিকাংশ অভিভাবকই শিশুকে শেখানোর সঠিক পথ জানেন না। তাই যা সবচেয়ে সহজলভ্য মনে হয়—চেঁচানো, তাগিদ দেওয়া, নিষেধ করা—সেই পথই বেছে নেন। কিন্তু এগুলো শিক্ষা নয়, প্রতি-শিক্ষা। এ শাসন শিশুর মনে গেঁথে দেয় ভয়, অপরাধবোধ আর দূরত্ব।
তিনি আরও বললেন, “শিশু যখন ভুল করে, তার পেছনে দুটি কারণ থাকে। এক: ভুলটি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে—অসাবধানতা, বয়সের দোষ, পরিবেশের প্রভাব। খেলতে খেলতে ট্রে-সমেত চা পড়ে গেলে তাকে ধমকানোর কিছু নেই; বরং ট্রে যেন পথের মাঝে না থাকে, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। দুই: শিশু এখনো সেই দক্ষতাটি শেখেনি। ‘বসে পড়ো’, রাত করে কাজ কেন করো’—এগুলো শুধু তিরস্কার, শিক্ষা নয়। শিশু হয়তো জানেই না কীভাবে সময়ের পরিকল্পনা করতে হয়। তাকে শেখাতে হবে, ধমকাতে নয়।
একটি সুন্দর উদাহরণ দিলেন তিনি। মা যদি শিশুকে বলেন: “সোনা, টিভি দেখতে বা খেলতে আমি মানা করছি না। তুমি যা ভালোবাসো, করো। কিন্তু পড়াশোনাটাও তো করতে হবে, তাই না? চলো, আমরা দুজনে মিলে একটা মজার সময়সূচি বানাই। তোমার প্রিয় কার্টুন কোনটি? ছয়টায়? ঠিক আছে, ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত শুধু কার্টুন। তারপর আমি তোমার সঙ্গে লুডো খেলব। তারপর নিজের মনের আনন্দে বই খুলে বসবে। দেখবে, কাজও হয়ে যাবে, মনও ভরে থাকবে।
এই কথাগুলো শুনে ঘরে নেমে আসে শান্তি। চেঁচামেচির বদলে আসে সহযোগিতা, তিরস্কারের বদলে আসে ভালোবাসার পরিকল্পনা।
আর সেই মাকে তিনি পরামর্শ দিলেন: স্বামীকে সরাসরি ভুল বলে তর্ক করবেন না। তাঁকে নিয়ে বসুন এক সন্ধ্যায়, দুজনে মিলে শিশু লালন-পালনের কিছু সুন্দর বই পড়ুন। শান্ত পরিবেশে, হাতে হাত রেখে। এটা তর্ক নয়, একসঙ্গে শেখার মুহূর্ত হবে।
তিনি বিশেষ করে নারীদের বলেন, তোমাদের কাছে আছে এক অলৌকিক অস্ত্র—কোমল ভাষা। একটি মৃদু, মধুর কথা পুরুষের হৃদয়ে তলোয়ারের চেয়েও গভীর আঘাত করে। কিন্তু আঘাতটা ভালোবাসার, পরিবর্তনের।
একটি স্মরণীয় ঘটনা শোনালেন। এক নারী এসেছিলেন কেঁদে কেটে। স্বামী অন্য এক নারীর প্রেমে পড়েছেন—যিনি বয়সে বড়, সৌন্দর্যে সাধারণ, অর্থ-কড়িও নেই। তবু স্বামী তাঁকেই বেছে নিয়েছেন। কারণ? সেই নারীর কথা ছিল মধুতে ডোবানো। একটি মাত্র গুণ—কোমল ভাষা—তাঁকে জয় করেছিল।
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন, “কথার শক্তি তলোয়ারের শক্তির চেয়েও প্রবল।
সুতরাং, হে মা, হে স্ত্রী, তোমার কণ্ঠ যদি ফুলের পাপড়ির মতো নরম হয়, তোমার শব্দ যদি মধুর বৃষ্টির মতো ঝরে, তবে সেই কথাগুলোই তোমার স্বামীকে রূপান্তরিত করবে একজন সচেতন, স্নেহময় পিতায়। আর তোমার সন্তান বড় হবে ভালোবাসার আলোয়, তিরস্কারের ছায়ায় নয়।



