জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

গায়বাতের যুগে ‘ইবলিসের জাল’ ও ঈমান রক্ষার লড়াই

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইমাম মাহদী (আ.)–এর গায়বাতের যুগ কোনো নিশ্চিন্ত আধ্যাত্মিক অবকাশ নয়; এটি এক গভীর ও বিপজ্জনক পরীক্ষার সময়। এই যুগে ঈমানের শত্রু আর তরবারি হাতে আসে না—সে আসে যুক্তির মুখোশ পরে, শব্দের বিষ মিশিয়ে, সন্দেহের জাল বিস্তার করে। আহলুল বাইতের শিক্ষা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়—শেষ যুগের সবচেয়ে বড় বিপদ নিছক অজ্ঞতা নয়; বরং শয়তানি শক্তি ও আহলুল বাইতের প্রকাশ্য শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত সুসংগঠিত বিশ্বাসগত ফিতনা।

গায়বাতের যুগে সবচেয়ে বড় বিপদ কেবল অজ্ঞানতা নয়; বরং পরিকল্পিত, কাঠামোবদ্ধ ও মতাদর্শিক বিভ্রান্তি—যা শয়তানি শক্তি এবং আহলুল বাইতের প্রকাশ্য শত্রুদের (নাসিবিদের) দ্বারা পরিচালিত হয়।

ইলাহি হিকমত এমনটাই নির্ধারণ করেছে যে, গায়বাতের যুগ হবে না ঈমানি স্থবিরতা ও প্রশান্তির সময়; বরং তা হবে পরীক্ষা, সংঘর্ষ ও বিশ্বাসগত ফিতনায় ভরা এক জটিল অধ্যায়। এই যুগ যেন এক ঘন অন্ধকার—যেখানে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বাহ্যিক চাকচিক্য ও বিভ্রান্তিকর দাবির আড়ালে অস্পষ্ট হয়ে যায়।

এই সময়ে ফিতনাগুলো তরবারি ও সেনাবাহিনী নিয়ে আসে না; আসে শব্দের বিষ, বুদ্ধিবৃত্তিক সন্দেহ এবং বিকৃত চিন্তার মাধ্যমে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো ইবলিসের জাল”—যে জাল মানুষের ঈমানকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয় এবং তাকে ولایت (ইমামত)-এর পথ থেকে বিচ্যুত করে।

এই বাস্তবতায় ঈমানি ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা এবং বিশুদ্ধ জ্ঞানমূলক উৎসের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকা কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়—বরং টিকে থাকার অপরিহার্য শর্ত। যে কেউ আহলুল বাইতের মুক্তির নৌকায় থাকতে চায়, তার জন্য এসব ফিতনাকে চিহ্নিত করা ও নিষ্ক্রিয় করা একটি ব্যক্তিগত দায়িত্ব।

যদি ঈমান দৃঢ় না হয়, যদি কুরআন ও বিশুদ্ধ শিয়া হাদিসের শরণাপন্ন হওয়ার প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র হাতে না থাকে, তবে সন্দেহের প্রথম প্রবল ঢেউতেই মানুষ ঝরা পাতার মতো ধর্মত্যাগের দিকে গড়িয়ে পড়বে। কারণ উপস্থিত ইমামের অনুপস্থিতিতে কেবল ইলাহি জ্ঞানের ধারক ও হুজ্জতের রক্ষকরাই এই ভয়ংকর ঝড়ের সামনে প্রতিরোধপ্রাচীর গড়ে তুলতে পারেন।

ইমাম হাদি (আ.)–এর নির্ণায়ক হাদিস: আলেমদের অস্তিত্বগত ভূমিকা

ওহী ও ইমামতের সীমা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে ইমাম হাদি (আ.) এক গভীর তাৎপর্যময় হাদিসে বলেন—

«لَوْ لَا مَنْ يَبْقَى بَعْدَ غَيْبَةِ قَائِمِكُمْ ع
مِنَ الْعُلَمَاءِ الدَّاعِينَ إِلَيْهِ وَ الدَّالِّينَ عَلَيْهِ،
وَ الذَّابِّينَ عَنْ دِينِهِ بِحُجَجِ اللَّهِ،
وَ الْمُنْقِذِينَ لِضُعَفَاءِ عِبَادِ اللَّهِ
مِنْ شِبَاكِ إِبْلِيسَ وَ مَرَدَتِهِ،
وَ مِنْ فِخَاخِ النَّوَاصِبِ،
لَمَا بَقِيَ أَحَدٌ إِلَّا ارْتَدَّ عَنْ دِينِ اللَّهِ،
وَ لَكِنَّهُمُ الَّذِينَ يُمْسِكُونَ أَزِمَّةَ قُلُوبِ
ضُعَفَاءِ الشِّيعَةِ كَمَا يُمْسِكُ صَاحِبُ السَّفِينَةِ سُكَّانَهَا،
أُولَئِكَ هُمُ الْأَفْضَلُونَ عِنْدَ اللَّهِ عَزَّ وَ جَلَّ

অর্থ:যদি তোমাদের কায়েমের গায়বাতের পর এমন আলেমরা অবশিষ্ট না থাকতেন—
যারা মানুষের দৃষ্টি তাঁর দিকে ফেরায়, তাঁর পথ নির্দেশ করে,
আল্লাহর হুজ্জত দিয়ে তাঁর ধর্ম রক্ষা করে, এবং আল্লাহর দুর্বল বান্দাদের ইবলিস ও তার বিদ্রোহী সহযোগীদের জাল থেকে এবং নাসিবিদের ফাঁদ থেকে উদ্ধার করে— তবে কেউই অবশিষ্ট থাকত না, যে আল্লাহর ধর্ম থেকে ফিরে যেত না। কিন্তু তারাই দুর্বল শিয়াদের হৃদয়ের লাগাম ধরে রাখে, যেমন নৌকার মাঝি নৌকার যাত্রীদের রক্ষা করে।
তারাই আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ।

এই হাদিস স্পষ্ট করে দেয়—গায়বাতের যুগে ধর্মত্যাগ কেবল সম্ভাবনা নয়; বরং অনিবার্য পরিণতি, যদি না এই আলেমরা উপস্থিত থাকেন। তাঁরা হলেন সেই নাবিক, যারা ঝড়ের মধ্যে শিয়াদের হৃদয়ের নৌকাকে ডুবে যেতে দেন না।

নাসিবি ফিতনার ভয়াবহতা: ইমাম হাসান আসকারি (আ.)–এর সতর্কবাণী

নাসিবি চিন্তাধারা ও তাদের তথাকথিত জ্ঞানের বিপদ সম্পর্কে ইমাম হাসান আসকারি (আ.) বলেন—

وَ هُمْ أَضَرُّ عَلَى ضُعَفَاءِ شِيعَتِنَا
مِنْ جَيْشِ يَزِيدَ عَلَى الْحُسَيْنِ بْنِ عَلِيٍّ ع وَ أَصْحَابِهِ،
فَإِنَّهُمْ يَسْلُبُونَهُمُ الْأَرْوَاحَ وَ الْأَمْوَالَ،
وَ لِلْمَسْلُوبِينَ عِنْدَ اللَّهِ أَفْضَلُ الْأَحْوَالِ

অর্থ: তারা (নাসিবি আলেমরা) আমাদের দুর্বল শিয়াদের জন্য ইয়াজিদের সেনাবাহিনীর চেয়েও ক্ষতিকর; কারণ তারা মানুষের দেহ নয়—ঈমান কেড়ে নেয়। অথচ যাদের দেহ ও সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তারা আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে।

এখানে স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে—শারীরিক নিধনের চেয়েও বিশ্বাসগত ধ্বংস অনেক বেশি ভয়ংকর।

নৌকার মাঝি: আলেমের গভীর উপমা

আলেমদের “صاحب السفينة” (নৌকার মাঝি) হিসেবে তুলনা অত্যন্ত গভীর অর্থ বহন করে। মাঝি শুধু পথ জানে না—সে জানে কীভাবে উত্তাল ঢেউয়ে নৌকা সামলাতে হয়। সন্দেহে ভরা সমুদ্রে দুর্বল শিয়ারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। আলেমের কাজ কেবল বিধান বলা নয়; বরং— «إمساك أزِمّة القلوب»
হৃদয়ের লাগাম ধরা—আস্থা সৃষ্টি করা, মানসিক স্থিতি দেওয়া এবং মানুষকে বিভ্রান্তির কাছে আত্মসমর্পণ থেকে রক্ষা করা।

উপসংহার

ইমাম হাদি (আ.)–এর বক্তব্যের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো— «أُولَئِكَ هُمُ الْأَفْضَلُونَ عِنْدَ اللَّهِ» তারাই আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ ইমামের গায়বাতের যুগে ঈমান রক্ষার ভার তাঁদের কাঁধেই ন্যস্ত। সবশেষে স্মরণ রাখা জরুরি—আলেম বলতে কেবল নির্দিষ্ট কোনো ধর্মীয় পোশাকধারী শ্রেণিকে বোঝায় না। বরং প্রত্যেক সেই চিন্তক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী—যিনি কুরআন ও ইত্রতের আলোকে সমাজকে সত্যের পথে পরিচালিত করেন—এই দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।গায়বাতের যুগে ঈমান বাঁচে—জ্ঞান, সচেতনতা ও সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্বের হাত ধরে।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button