গাজায় শিশুরা দুইবার শহীদ হয়!
ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো গাজার শিশুদের জীবনে দু’বার আঘাত হানে—একবার ভয় ও আতঙ্কে, আরেকবার তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে। এই দুই মৃত্যুর মধ্যকার সময়ের ব্যবধান খুব স্বল্প।
সেই শিশুটি যে সবসময় উঁচু থেকে আকাশ দেখতে ভালোবাসত—ফেরিস হুইলে চড়ে ভাইবোনের সঙ্গে, কিংবা বিমানের জানালা দিয়ে অন্য শহরে যাওয়ার সময়। কিন্তু না, সে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের শিকার হবে, যা তার বাড়ির নিচে আঘাত হেনে তাকে আকাশের অজানা উচ্চতায় ছুড়ে ফেলবে! উড়তে ভালোবাসলেও সে তো মেঘের নরম কোলে বসে থাকতে চাইত, ধুলো আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নয়—যেগুলো তাকে জড়িয়ে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগেও সে বোনের পাশে বসে ছিল, আর মা ঘরের সামান্য খাবার নিয়ে একবেলা চালানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এখন তারা তিনজনই আকাশে ভাসছেন।
গাজায় মানুষের আয়ু খুব সংক্ষিপ্ত। তার আয়ুও কয়েক সেকেন্ড পরই তার উড়ার স্বপ্ন শেষ হবে। মেঘপুঞ্জ থেকে সে শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়বে, আর ইটের পর ইট তার মাথার ওপর ধসে পড়বে তার নামও শীঘ্রই শিশু শাহিদদের তালিকায় যুক্ত হবে, কিন্তু এই নিষ্ক্রিয় পৃথিবীর বিবেক তবুও জাগ্রত হবে না!
“পরিচয় অজানা শিশু”—এই শব্দগুচ্ছ প্রথম আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ করেছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে, যখন ইরানের কেরমানে সন্ত্রাসী হামলায় ছোট্ট রেহানার প্রাণ গিয়েছিল। শহীদদের তালিকায় “প্রায় দুই বছর বয়সী, গোলাপি জ্যাকেট ও হার্টের ডিজাইনের ইয়াররিং” বর্ণনায় সেই “পরিচয় অজানা শিশু” দেখে আমরা স্তব্ধ হয়েছিলাম। আজও সেই স্মৃতি আমাদের চোখ ভিজিয়ে দেয়।
কিন্তু গাজার “পরিচয় অজানা শিশু”র সংখ্যা তো অগণিত। মাত্র কয়েকদিন আগেই এক ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের তোলা ছবিতে দেখা গেল—সাদা কাফনের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে রেহানার বয়সী এক ক্ষীণদেহী শিশুর মুখ।
সত্যি বলতে, ছবিটি দেখে বুঝতে পারলাম না কী অনুভব করা উচিত! খুশি হবো এই ভেবে যে তার মা বেঁচে নেই, যে আর্তনাদ করে কাঁদবে? নাকি দুঃখ পাবো এই ভেবে যে তার জন্য কাঁদারও কেউ নেই? গাজায় আজ শিশুদের কাঁদার কেউ নেই। তাদের কাঁদার মানুষটিকেও তারা হারিয়েছে। ইসরায়েলের “অশেষ কৃপায়” মায়েরা তো আগেই চলে গেছেন।
গাজায় শিশুরা যেন দুইবার শহীদ হয়!
গত ৫৫৭ দিন ধরে ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণের মধ্যেও গাজার শিশুরা যে সাহস দেখিয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। অনেক প্রাপ্তবয়স্কই স্বীকার করেন, বিস্ফোরণের শব্দ বা যুদ্ধবিমানের গর্জন শুনলেই তাদের শিরদাঁড়া শিউরে ওঠে—সেখানে শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ!
এক ছোট্ট মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। আতঙ্কে তার ঘুম ভাঙলেও সে চোখ বন্ধ করে রাখে, ঠোঁট কাঁপছে, দাঁত ঠকঠক করছে। কারণ, ইসরায়েলি একটি যুদ্ধবিমান তাদের বাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে গেছে, কয়েক গজ দূরেই ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। এই বাড়িতে কেউ হতাহত হয়নি, কিন্তু ওই শিশুটির কোমল হৃদয় কতবার এমন আতঙ্ক সহ্য করতে পারে? কতবার সে মেনে নেবে যে ঘুমানোর সময়ই হঠাৎ মাটি কেঁপে উঠবে, আকাশ ফাটবে গোলার শব্দে, আর কোথাও লুকোনোর জায়গা থাকবে না? ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র যেন শিশুদের দুইবার মারে—একবার যুদ্ধবিমানের শব্দ ও আতঙ্কে, আরেকবার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে টুকরো টুকরো করে। এই দুই মৃত্যুর মাঝে থাকে শুধু এক ঝলক বিভীষিকা!
যে চোখ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল
কান্নাই ছিল মেয়েটির একমাত্র সান্ত্বনা। যখন আকাশ ফেটে ক্ষেপণাস্ত্র নামে, যখন তার চোখের সামনে সহপাঠীরা শহীদ হয়, যখন ক্ষুধা তার দুর্বল শরীরে ব্যথা দেয়—কান্নাই ছিল তার ভরসা। কিন্তু গাজায় এক মেয়েকে চিনি, যাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র তার চোখও কেড়ে নিয়েছে। খরগোশের মতো নরম চুলের সেই মেয়েটির মুখ পুড়ে গেছে, চোখ দুটিতে চিরতরে অন্ধকার নেমেছে। তার রঙিন শিশুজগত এখন শুধু স্মৃতি। এখন সে শব্দের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু গাজায় শব্দ বলতে কী আছে? শুধু বিস্ফোরণের আওয়াজ—যা তাকে শুধু হারানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
যে শোকের মাতম প্রতিদিনই ঘটে
গাজার এই শোকের মাতমে আমি বারবার কেঁদেছি—সেই বাবার জন্য যে তার ছয় মাস বয়সী শিশুর মাথাবিহীন দেহ হাতে নিয়ে শত্রুর নিষ্ঠুরতার কথা বলেছিল, তারপর নিজ হাতে একটি ছোট কবর খুঁড়েছিল। কয়েকদিন আগে গাজার একটি হাসপাতালের সামনের দৃশ্য: এক বাবা তার নবজাতকের মাথাবিহীন দেহ হাতে নিয়ে বলছে, “হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিইয়ামাল ওয়াকিল।” তার মা ধুলায় মাখা অবস্থায় বলছিলেন, “আমরা শুধু বসে ছিলাম। হঠাৎ সবজায়গায় আগুন। আমার মেয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের তার মাথা নেই, ” ছোট বোনটি মায়ের পা জড়িয়ে কাঁদছে: “আমি আমার বোনের জন্য পার্টি করতে চেয়েছিলাম!” মা তাকে জড়িয়ে ধরে বলছে: “এটাই আমার একমাত্র সম্পদ!” এই মা হয়তো জানেন না, এই “শেষ সম্পদ”-ও কতদিন থাকবে! গাজার শিশুরা: আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এতিম সংকট মুখোমুখি।
ফিলিস্তিনি পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য:
-
৩৯,৩৮৪ শিশু ইয়াতিম হয়েছে
-
১৭,০০০ শিশু শাহিদ হয়েছে (নবজাতকসহ)
-
১৭,০০০ শিশু পিতা-মাতা উভয়কেই হারিয়েছে
একে “সমসাময়িক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ইয়াতিম সংকট” বলা হচ্ছে। কয়েকদিন আগে বিশ্বের মতো গাজাতেও শিশু দিবস ছিল—এমন একটি দিন যখন কোনো শিশু হাসেনি। গাজার শিশুরা প্রতিদিন যে যুদ্ধের মুখোমুখি হয়, তা কোনো পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। এগুলো শুধু কিছু গল্প—গাজার অগণিত বেদনার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কয়েকটি গল্প মাত্র।
মিডিয়া মিহির/বিশ্ব