জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

খরা: মানুষের অন্তরজাগরণের ইশারা

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: মেঘ বপনের (Cloud Seeding) মতো আধুনিক প্রযুক্তি খরা মোকাবিলায় কিছু সীমিত প্রভাব ফেলতে পারে বটে, কিন্তু এটি বৃষ্টি আনার নিশ্চিত উপায় নয়। ইসলামী বিশ্বদৃষ্টিতে বৃষ্টি কেবল একটি আবহাওয়াগত ঘটনা নয়—এটি আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের প্রকাশ। আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) নাহজুল বালাগার সুপ্রসিদ্ধ খুতবা ১১৫-এ এ সত্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন: আকাশ ও পৃথিবী, তাদের সকল গতি ও স্থিতি, আল্লাহরই আনুগত্যে পরিচালিত।

প্রয়াত আল্লামা মিসবাহ ইয়াজদী, তাঁর নাহজুল বালাগা-বিষয়ক ব্যাখ্যানে (১৭/০২/১৩৮৭ ইরানি তারিখ), খরার বিষয়টিকে কেবল একটি প্রাকৃতিক সংকট হিসেবে নয়, বরং মানবের আত্মিক অবস্থার সাথে সম্পর্কিত গভীর ইলাহি সংকেত হিসেবে বিশ্লেষণ করেন।

প্রকৃতির সীমা ও মানবের অক্ষমতা

খরা দেখা দিলে মানুষ প্রথমেই বস্তুগত সমাধান খোঁজে— মেঘ বপন (Cloud Seeding), বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ, আধুনিক আবহাওয়া প্রযুক্তি ইত্যাদি। এগুলোর কিছু কার্যকারিতা থাকতে পারে; তবে মৌলিক সত্য হলো—মানুষ প্রকৃতির চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রক নয়। মেঘ যদি না থাকে, তবে বৃষ্টি আনার কোনো মানবিক উদ্যোগই কার্যকর হয় না। এই বাস্তবতা মানুষকে তার সীমাবদ্ধতা স্মরণ করিয়ে দেয়।

ইলাহি নির্দেশ ও সৃষ্টির আনুগত্য

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বৃষ্টি প্রার্থনার উপলক্ষে প্রদত্ত এক খুতবায় বলেন, “তোমরা যে আকাশ ও পৃথিবী প্রত্যক্ষ করো— এই আকাশ, যেখানে কখনো বৃষ্টি বর্ষিত হয় এবং কখনো হয় না; আর এই পৃথিবী, যেখান থেকে কখনো শস্য ও সবুজ অঙ্কুর উদ্ভূত হয় এবং কখনো হয় না— উভয়ই আল্লাহর বান্দা, তাঁরই সৃষ্টি এবং সম্পূর্ণভাবে তাঁর আদেশের অধীন। আল্লাহ যখন নির্দেশ দেন, ‘বর্ষিত হও’, তখনই তা বর্ষিত হয়; আর যখন বলেন, ‘থেমে থাকো’, তখনই তা থেমে যায়।” (নাহজুল বালাগা, খুতবা ১১৫)

এই বাণী কেবল একটি ধর্মীয় ঘোষণা নয়; এটি কসমিক অর্ডার-এর, অর্থাৎ সৃষ্টিজগতের ইলাহি নিয়মশৃঙ্খলার মূলতত্ত্ব।

খরা: বাহ্যিক সংকট থেকে অন্তরজাগরণের সেতুবন্ধন

মানুষের প্রয়োজন দু’ধরনের:
১. বস্তুগত—পানীয় জল, কৃষি, জীবিকা
২. আত্মিক—অর্থপূর্ণতা, সচেতনতা, জিকির, অন্তরশুদ্ধি

আল্লামা মিসবাহ ইয়াজদীর ব্যাখ্যায় খরা মানুষের অন্তরের গভীরে নাড়া দেয়ার একটি ইলাহি উপায় হিসেবে উন্মোচিত হয়। বৃষ্টির অভাব বাহ্যিক সংকট তৈরি করে, আর সেই সংকট মানুষের মধ্যে অসহায়তার অনুভব জাগিয়ে তোলে। এই অসহায়তাই তাকে ঈশ্বরের দিকে ফিরে যেতে শেখায়।

দুনিয়াবি চাহিদা কখনো কখনো আত্মিক জাগরণের দরজা খুলে দেয়।

আসলে মানুষের প্রয়োজন কী?

মাটি ভিজে ফসল ফলানো মানুষের জীবনের জন্য জরুরি— কিন্তু মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন কি কেবল এতটুকুই? ইসলামী দৃষ্টিকোণ বলছে—না।

মানুষের আসল প্রয়োজন হলো:

  • আত্মার পূর্ণতা

  • চরিত্রের পরিশুদ্ধি

  • ঈশ্বরসচেতনতা

  • নৈতিক উৎকর্ষ

এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আল্লাহ অনেক সময় বস্তুগত অভাবকেও এক ধরনের “সম্ভাষণ” হিসেবে পাঠান—যা মানুষের অন্তরে অনুরণন তোলে, তাকে জাগিয়ে দেয়, তাকে তার প্রকৃত গন্তব্যের দিকে আহ্বান করে।

সংকটের আড়ালে একটি আহ্বান

খরা কেবল পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ নয়; এটি মানুষের জন্য এক ইলাহি স্মারক, এক অন্তরজাগরণের ইশারা।
আল্লাহ দয়ালু; তিনি মানুষের আত্মিক বিবেচনাশক্তি জাগিয়ে তুলতে পার্থিব অভাবকেও মাধ্যম বানিয়ে দেন।

বৃষ্টি শুধু জমিকে নয়—মানুষের হৃদয়কেও সজীব করতে পারে, যদি সে সংকেতটি বুঝতে পারে।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button