কোরআন ও নবী–ইমামদের নির্দেশনায় বস্তুগত ও আত্মিক সম্পর্কের সংঘাত নিরসনের পথ কী?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: মানুষ সামাজিক সত্তা। পরিবার, আত্মীয়তা, গোষ্ঠী, দল ও স্বার্থের বন্ধনে তার জীবন আবদ্ধ। একই সঙ্গে ঈমান, ন্যায়, তাকওয়া ও সত্যের সঙ্গে তার রয়েছে গভীর আত্মিক সম্পর্ক। বহু সময় এই দুই ধরনের সম্পর্ক—বস্তুগত ও আত্মিক—পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। তখন প্রশ্ন জাগে: কোনটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে? কোরআন ও নবী–ইমামদের জীবনাদর্শ এই দ্বন্দ্বের একটি সুস্পষ্ট, নৈতিক ও চিরন্তন সমাধান তুলে ধরে।
বিস্তারিত উত্তর
মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, তাই তার জীবনে নানাবিধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কখনও তা রক্তসূত্রের—যেমন পিতা ও সন্তান, মাতা ও সন্তান, ভাই–বোন, চাচা–ভাতিজা কিংবা মামাতো–ফুফাতো সম্পর্ক। কখনও সম্পর্ক হয় বৈবাহিক সূত্রে—স্বামী–স্ত্রী, শ্বশুর–বউ, জামাই–শাশুড়ির মতো। আবার কখনও তা গোত্র, বংশ, দল বা রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। এসব সম্পর্কের কিছু মানুষের ইচ্ছাধীন, কিছু আবার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ও অনিবার্য। এগুলো মূলত বস্তুগত বা পার্থিব সম্পর্ক।
এর পাশাপাশি মানুষের জীবনে রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক—যার ভিত্তি ঈমান ও নৈতিকতা। কোরআন মুমিনদের সম্পর্কে ঘোষণা করেছে: إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পরের ভাই।(সূরা হুজুরাত, ১০) —এটি কোনো রক্তের সম্পর্ক নয়, বরং ঈমানের বন্ধন। একইভাবে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: أَنَا وَ عَلِىٌّ اَبَوا هَذِهِ الْأُمَّةِ
আমি ও আলী এই উম্মাহর পিতা। এটি নবী ﷺ, ইমাম আলী (আ.) ও সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এক গভীর আত্মিক সম্পর্কের ঘোষণা।
সারকথা, মানুষের জীবনে পার্থিব ও আত্মিক—উভয় ধরনের সম্পর্কই বিদ্যমান। কিন্তু কোনো কোনো সময় এই দুইয়ের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং তখন মানুষকে বেছে নিতে হয়। আত্মিক সম্পর্ক রক্ষা করতে গেলে অনেক সময় পার্থিব সম্পর্ক থেকে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে সরে আসতে হয়। আর যদি কেউ পার্থিব সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়, তবে আত্মিক বন্ধন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রথম দৃষ্টান্ত: আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ للهِ وَ لَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَ الْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيّاً أَوْ فَقِيراً فَاللهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَ إِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيراً
হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় থাকো, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য দাও—তা যদি তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে যায়, অথবা পিতা–মাতা ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধেও হয়। সে ব্যক্তি ধনী হোক বা দরিদ্র—আল্লাহ উভয়েরই অধিক হকদার। সুতরাং প্রবৃত্তির অনুসরণ কোরো না, ন্যায়চ্যুত হবে। আর যদি তোমরা সত্য বিকৃত করো বা তা গোপন করো, তবে জেনে রেখো—আল্লাহ তোমাদের কাজ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।” (সূরা নিসা, ১৩৫)
এখানে আত্মীয়তার সম্পর্ক ন্যায় ও ঈমানের সঙ্গে সংঘর্ষে এসেছে। কোরআন স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে—আত্মীয়তার মোহ ত্যাগ করে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। অন্যথায় তা ঈমানহীনতার লক্ষণ।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত: সূরা মুজাদালার শেষ আয়াতে বলা হয়েছে: لَا تَجِدُ قَوْماً يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَ الْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللهَ وَ رَسُولَهُ وَ لَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُوْلَئِكَ كَتَبَ فِى قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَ أَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِّنْهُ وَ يُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِى مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوا عَنْهُ أُوْلَئِكَ حِزْبُ اللهِ أَلاَ إِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
তুমি এমন কোনো সম্প্রদায় পাবে না, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরোধীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে—যদিও তারা তাদের পিতা, সন্তান, ভাই কিংবা নিকট আত্মীয় হয়। তাদের হৃদয়ে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন… তারাই আল্লাহর দল, আর আল্লাহর দলই সফল। এখানে ঈমানের সম্পর্ককে রক্ত ও গোত্রের সম্পর্কের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে।
ইমাম আলী (আ.) ও আকিলের ঘটনা
ইমাম আলী (আ.) নিজ ভাষায় বলেন—তিনি তাঁর ভাই আকিলকে দেখেছিলেন চরম দারিদ্র্যে আক্রান্ত। আকিল অনুরোধ করেছিলেন, যেন রাষ্ট্রের সম্পদ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে তাকে কিছু দেওয়া হয়। ইমাম আলী (আ.) লোহার একটি টুকরো আগুনে গরম করে তার শরীরের কাছে ধরেন—ছোঁয়াননি—শুধু সতর্ক করার জন্য। আকিল যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে। তখন ইমাম আলী (আ.)বলেন:
হে আকিল! তুমি মানুষের জ্বালানো আগুনে ভীত, অথচ আমাকে আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুনের দিকে আহ্বান করছ! এখানে তিনি পারিবারিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে ন্যায় ও ঈমানকে স্থান দিয়েছেন।
নূহ (আ.) ও তাঁর পুত্র: চূড়ান্ত শিক্ষা
নূহ (আ.)–এর পুত্র কুফরের পথ বেছে নেয়। মহাপ্লাবনের সময় পিতা তাকে নৌকায় ওঠার আহ্বান জানান, কিন্তু সে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ার কথা বলে। আল্লাহর নির্দেশে সে ডুবে যায়। পরে নূহ (আ.) আল্লাহর কাছে প্রশ্ন করলে উত্তর আসে: يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ فَلَا تَسْئَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنِّى أَعِظُكَ أَنْ تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়; সে অসৎ কর্মের প্রতীক।” (সূরা হূদ, ৪৬)অর্থাৎ ঈমান ছিন্ন হলে রক্তের সম্পর্কও ভেঙে যায়।
উপসংহার
কোরআন ও নবী–ইমামদের জীবন আমাদের শেখায়—যেখানে বস্তুগত সম্পর্ক ও আত্মিক মূল্যবোধের সংঘাত ঘটে, সেখানে ঈমান, ন্যায় ও সত্যকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। আত্মীয়তা, স্বার্থ বা আবেগ যদি আল্লাহর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা ত্যাগ করাই প্রকৃত মুক্তির পথ।
পাদটীকা
(১) উয়ূনু আখবারির রিযা (আ.), লেখক: শাইখ সাদূক (ইবন বাবুওয়াইহ), সম্পাদনা: মাহদি লাজভার্দি, নাশরে জাহান, তেহরান, ১৩৭৮ হিজরি শামসি, প্রথম সংস্করণ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৫—“ইমাম রিযা (আ.) থেকে বর্ণিত বিভিন্ন কারণ ও ব্যাখ্যার অধ্যায়”।
(২) হযরত আবু তালিব (আ.)–এর চার পুত্র ছিলেন, যাদের প্রত্যেকের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল দশ বছর। বয়োজ্যেষ্ঠ থেকে কনিষ্ঠের ক্রমানুসারে তাঁরা হলেন: তালিব, আকিল, জাফর এবং হযরত আলী (আ.)। আবু তালিব (আ.) বিশেষভাবে আকিলকে স্নেহ করতেন। এ কারণে রাসুলুল্লাহ ﷺ আকিলকে বলতেন: “আমি তোমাকে দু’টি কারণে ভালোবাসি—এক, আত্মীয়তার কারণে; দুই, এ জন্য যে আমার চাচা আবু তালিব তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।” আকিল মুতার যুদ্ধে তাঁর ভাই জাফরের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। তিনি আরবদের বংশপরিচয় ও জাহেলি যুগের ইতিহাস সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানী ছিলেন এবং বিতর্কে ছিলেন তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও উপস্থিত জবাবদানে সক্ষম। তিনি ইমাম আলী (আ.)–এর শাহাদাতের আগে না পরে মুয়াবিয়ার কাছে গিয়েছিলেন—এ বিষয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে; তবে গবেষকদের মতে, তিনি শাহাদাতের পূর্বে যাননি। (দ্রষ্টব্য: নাহজুল বালাগার প্রাঞ্জল অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা, নাসির মাকারিম শিরাজি, হাদাফ প্রকাশনা, কুম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৯৭)।
(৩) আকিল নিজেই মুয়াবিয়ার কাছে তাঁর ঘটনার বর্ণনা এভাবে দেন: “আমার জীবন কঠিন হয়ে উঠেছিল। সন্তানদের একত্র করে আমি আমার ভাই আলী (আ.)–এর কাছে গেলাম। ক্ষুধা তাদের চেহারায় স্পষ্ট ছিল। তিনি বললেন—রাতে এসো, তোমাকে কিছু দেব। রাতে আমার এক সন্তান আমার হাত ধরে তাঁর কাছে নিয়ে গেল। বসার পর ইমাম (আ.) আমার সন্তানকে বাইরে যেতে বললেন। তারপর আমাকে বললেন—নাও! আমি ভেবেছিলাম স্বর্ণের থলি, হাত বাড়াতেই অনুভব করলাম—এক টুকরো লালচে গরম লোহা! আমি চিৎকার করে উঠলাম। তখন তিনি বললেন—তোমার মা তোমার জন্য ক্রন্দন করুক! এটি দুনিয়ার আগুনে উত্তপ্ত লোহা; আর তুমি আমাকে টেনে নিচ্ছ আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুনের দিকে! আমি ও তুমি তখন কী করব, যখন জাহান্নামের শিকল আমাদের গলায় পরানো হবে?” এরপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করেন:
﴿إِذِ الْأَغْلَالُ فِي أَعْنَاقِهِمْ وَالسَّلَاسِلُ يُسْحَبُونَ﴾ (সূরা গাফির, ৭১)।
তারপর বললেন: আল্লাহ তোমার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তার অতিরিক্ত কিছু আমার কাছে নেই। আকিল বলেন—এই ঘটনা শুনে মুয়াবিয়া বিস্ময়ে বলে ওঠে: ‘হায় হায়! নারীরা আর কখনো আলীর মতো সন্তান জন্ম দেবে না।’ (ইবন আবিল হাদীদ, শরহে নাহজুল বালাগা, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ২৫৩)।
(৪) নাহজুল বালাগা, সংকলক: শরীফ রাযী; সম্পাদনা: সোবহি সালেহ; হিজরত প্রকাশনী, কোম, ১৪১৪ হিজরি, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩৪৬, খুতবা নং ২২৪।



