কুরআনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

কোরআনি কাহিনীতে ‘পুনরুক্তি’র প্রজ্ঞা কী?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: সংক্ষিপ্ত উত্তর

কোরআনে যে কাহিনীগুলো একাধিকবার এসেছে, সেগুলোর পুনরুক্তি কোনো অকারণ পুনরাবৃত্তি নয়; বরং তা কোরআনের বহুমুখী উদ্দেশ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। একটি কাহিনীর ভেতরে থাকে বহু স্তর ও দিক—নৈতিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও শিক্ষামূলক। একবার বললেই তার সব দিক সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হয় না। তাই ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য সামনে রেখে একই কাহিনি পুনরায় উপস্থাপিত হয়েছে। প্রতিবারই নতুন কোনো দিক, নতুন কোনো বার্তা গুরুত্ব পায়। সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেও কোরআনের কাহিনীর পুনরুক্তি অলংকারসমৃদ্ধ ও সূক্ষ্ম নান্দনিকতায় ভরপুর, যা প্রসঙ্গভেদে নতুন তাৎপর্য সৃষ্টি করে।

বিস্তারিত উত্তর:

কোরআনি কাহিনীর পুনরুক্তির অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা

কোরআনে কাহিনীর পুনরাবৃত্তি মূলত সেই বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ফল, যেগুলোর দিকে কোরআন মানবজাতিকে আহ্বান জানায়। একটি কাহিনী বহু মাত্রিক হতে পারে—শুধু একবার বর্ণনা করলে তার সব হেদায়াতমূলক ও চরিত্রগঠনমূলক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। তাই যখনই নতুন কোনো পরিস্থিতি বা প্রসঙ্গ সামনে আসে, তখন সেই কাহিনীর নির্দিষ্ট একটি দিককে সামনে এনে তা পুনরায় বলা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে প্রসঙ্গ বদলে যায়, গুরুত্বের কেন্দ্রও বদলে যায়—আর সেই অনুযায়ী কাহিনীর উপস্থাপনাও ভিন্ন রূপ নেয়।

কোরআনে সবচেয়ে বেশি পুনরুক্ত কাহিনী হলো হযরত মূসা (আ.) ও ফেরাউনের কাহিনী এবং বনি ইসরাঈলের ইতিহাস। এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। একদিকে আরব সমাজের সঙ্গে ইহুদিদের ভৌগোলিক ও সামাজিক নৈকট্য, অন্যদিকে ইহুদিদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব। পাশাপাশি বনি ইসরাঈলের নবীদের সঙ্গে আচরণ ও তাদের সামষ্টিক চরিত্র, ইসলাম আবির্ভাবকালের আরব সমাজের আচরণের সঙ্গে বিস্ময়করভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। ফলে অতীত ইতিহাস, ইহুদি সমাজ ও তৎকালীন আরবদের আচরণের মধ্যে একটি গভীর যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল।

কোরআনে হযরত মূসা (আ.)–এর কাহিনীর পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়—মক্কি ও মাদানি সূরাগুলোতে এর সামগ্রিক সুর ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য।
মক্কি সূরাগুলোতে মূসা (আ.)–এর কাহিনীর মূল ফোকাস ফেরাউনের সঙ্গে তাঁর সংগ্রাম, বিতর্ক ও সত্য–মিথ্যার সংঘর্ষে। সেখানে বনি ইসরাঈলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব কমই আলোচিত হয়েছে—তাও কেবল তাদের আকীদাগত বিচ্যুতি প্রসঙ্গে।
অন্যদিকে মাদানি সূরাগুলোতে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মূসা (আ.) ও বনি ইসরাঈলের পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট এবং সামষ্টিক দুর্বলতা।

এ থেকেই স্পষ্ট হয় যে, মক্কি সূরাগুলোতে কাহিনীর পুনরুক্তির উদ্দেশ্য ছিল নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের মনোবল দৃঢ় করা—যাতে তারা মুশরিকদের বিরোধিতা ও নির্যাতনের মুখে অবিচল থাকতে পারেন। তবে কোরআনের এই উদ্দেশ্য শুধু সেই যুগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইতিহাসের প্রতিটি সময়েই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে ঈমানদারদের জালিম, ক্ষমতালোভী ও প্রভাবশালীদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। ইতিহাস ঘুরে ফিরে আসে, আর কোরআনের কাহিনীগুলো প্রতিটি যুগের জন্যই জীবন্ত দিকনির্দেশনা হয়ে থাকে।

হযরত নূহ (আ.) ও হযরত ইবরাহিম (আ.)–এর কাহিনীতেও একই নীতি পরিলক্ষিত হয়। মক্কা ও মদিনার ভিন্ন সামাজিক–রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে এসব কাহিনীর উপস্থাপনায় দৃষ্টিভঙ্গি ও গুরুত্বের কেন্দ্র বদলে গেছে।

সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়, কোরআন যখনই কোনো কাহিনী পুনরাবৃত্তি করে, তখন তা কখনোই হুবহু পুনরুক্তি নয়। প্রতিবারই সেখানে যুক্ত হয় নতুন সূক্ষ্মতা, নতুন অলংকার ও নতুন তাৎপর্য—যা নির্দিষ্ট প্রসঙ্গের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি কোরআনের ভাষাগত মু‘জিজা ও অতুলনীয় বাগ্মিতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। কারণ একই কাহিনী বিভিন্ন ভঙ্গিতে, বিভিন্ন রঙে ও বিভিন্ন আবহে উপস্থাপন করার এই ক্ষমতা সাধারণ মানবিক ভাষার সাধ্যের বাইরে। আশ্চর্যের বিষয় হলো—শ্রোতা বা পাঠক একাধিকবার একই কাহিনি শুনেও ক্লান্ত হয় না; বরং প্রতিবারই তাতে নতুনত্ব, সতেজতা ও হৃদয়স্পর্শী আনন্দ অনুভব করে।

পাদটীকা

(১)মাহমুদ ইবন হামজা কিরমানি—ষষ্ঠ হিজরি শতকের একজন বিশিষ্ট কোরআন গবেষক—এই বিষয়ে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার নাম «البرهان في توجيه متشابه القرآن»। এ গ্রন্থে তিনি কোরআনের পুনরুক্ত আয়াতগুলোর পারস্পরিক সূক্ষ্ম পার্থক্য, অর্থগত ভিন্নতা ও প্রাসঙ্গিক দিকগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। উক্ত গ্রন্থের নির্বাচিত অংশ আমরা «التمهيد في علوم القرآن»–এর পঞ্চম খণ্ডে, বিশেষত “বয়ানগত মু‘জিজা” বিষয়ক আলোচনায় সংকলন করেছি। বিস্তারিত দেখতে পারেন:
«التمهيد في علوم القرآن»، খণ্ড ৫, অধ্যায়: “পুনরাবৃত্ত আয়াতসমূহে নিহিত সূক্ষ্মতা ও নান্দনিকতা”।

(২)এই আলোচনা সংকলিত হয়েছে গ্রন্থ «নাক্দে শুবহাত পিরামুনে কোরআনে কারিম» থেকে। লেখক: মুহাম্মদ হাদি মা‘রিফাত। অনুবাদকবৃন্দ: হাসান হাকিমবাশি, আলী আকবর রুস্তমি, মির্জা আলীজাদে ও হাসান খারকানি। প্রকাশক: তামহীদ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৮৮ হিজরি শামসি। উল্লিখিত আলোচনা গ্রন্থটির ৫২৯–৫৩০ পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button