কেন সব নবী-রাসূল পুরুষ ছিলেন?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৩ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ইতিহাসের দীর্ঘ পাতায় আল্লাহ তাআলা ১,২৪,০০০-এরও বেশি নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন—কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন পুরুষ। কোনো নারীকে নবুওতের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এ প্রশ্নের উত্তর আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞা, নারী-পুরুষের সৃষ্টিগত পার্থক্য এবং দায়িত্বের প্রকৃতির মধ্যে নিহিত। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো—নবুওত না পাওয়া নারীদের মর্যাদা কমায়নি বরং আল্লাহ তাআলা নারীদের অন্য মহান পথে আরো উচ্চতর সম্মান দান করেছেন।
নবুওতের দায়িত্ব কতটা কঠিন ও বিপজ্জনক
নবী মানে শুধু ওহী গ্রহণকারী নন, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরো মানবজাতির নেতা, সংস্কারক ও যোদ্ধা। এ দায়িত্বের কিছু বাস্তব চিত্র:
১.দীর্ঘ ও বিপদসঙ্কুল যাত্রা (হযরত ইব্রাহীম আ. শাম থেকে মক্কায়)
২.একা শত্রুর দরবারে দাঁড়ানো (হযরত মূসা আ. ফিরআউনের সামনে)
৩.পাথর নিক্ষেপ, অবমাননা, ষড়যন্ত্র, নির্যাতন সহ্য করা
৪.সমগ্র জাতির সামনে প্রকাশ্য বিতর্ক ও সংগ্রাম করা
এসব কাজের জন্য যে শারীরিক শক্তি, সাহস, সামাজিক চলাচলের স্বাধীনতা ও দৃঢ়তা প্রয়োজন, আল্লাহ তাআলা তা পুরুষদের মধ্যে অধিক পরিমাণে দিয়েছেন। নারীদেরকে দিয়েছেন অসীম কোমলতা, স্নেহ, ধৈর্য ও সূক্ষ্মতা—যা মাতৃত্ব ও সমাজের ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য।
নারীরাও আল্লাহর সর্বোচ্চ নির্বাচিত
১. হযরত মরিয়ম আলাইহাস সালাম কুরআনে সূরা আলে ইমরানে ফেরেশতারা সরাসরি তাঁকে সম্বোধন করে বলেছেন:
﴿وَإِذْ قَالَتِ الْمَلَائِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَاكِ وَطَهَّرَكِ وَاصْطَفَاكِ عَلَىٰ نِسَاءِ الْعَالَمِينَ﴾
আর স্মরণ করো, যখন ফেরেশতাগণ বললেন, হে মরিয়ম! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করেছেন, তোমাকে পবিত্র করেছেন এবং তোমাকে বিশ্বের সকল নারীর উপর মনোনীত করেছেন। (সূরা আলে ইমরান: ৪২)

একই সূরায় আরও বলা হয়েছে:
﴿فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنًا﴾
অতঃপর তাঁর রব তাঁকে উত্তমরূপে কবুল করলেন এবং তাঁকে সুন্দরভাবে লালন-পালন করলেন। (আলে ইমরান: ৩৭)
২. হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (সা.আ.)শিয়া-সুন্নি উভয়ের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে প্রমাণিত যে, তিনি «مُحَدَّثَة» ছিলেন—অর্থাৎ ফেরেশতা তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত:
«مَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَشْبَهَ كَلاَمًا وَحَدِيثًا بِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ فَاطِمَةَ»
আমি ফাতিমার চেয়ে কথাবার্তা ও আচরণে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ আর কাউকে দেখিনি।
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন: «كَانَتْ فَاطِمَةُ مُحَدَّثَةً وَلَمْ تَكُنْ نَبِيَّةً»
ফাতিমা মুহাদ্দাসা (ফেরেশতার সঙ্গে কথা বলতেন) ছিলেন, কিন্তু নবী ছিলেন না।
তাহলে পার্থক্য কোথায়?
১.নবী → ওহী আনয়ন করেন, শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করেন, পুরো উম্মতের নেতৃত্ব দেন।
২.মুহাদ্দাসা → ফেরেশতার সঙ্গে কথা বলেন, আধ্যাত্মিক বার্তা পান, কিন্তু শরীয়ত আনয়নের দায়িত্ব নেই।
মর্যাদার দিক থেকে অনেক আলেমের মতে হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর স্তর নবীদের চেয়েও উচ্চতর।
যদি নারী নবী পাঠানো হতো, তাহলে কী সমস্যা হতো?
১. সেই যুগের সমাজ নারীদের দীর্ঘ যাত্রা, প্রকাশ্য বক্তৃতা, শত্রুদের মোকাবিলা করাকে সহজে গ্রহণ করত না। ২. শত্রুরা নারী নবীকে আরো বেশি অবমাননা, অশ্লীলতা ও ষড়যন্ত্রের শিকার করত। ৩. নারীর প্রাকৃতিক দায়িত্ব (ঋতুস্রাব, গর্ভধারণ, সন্তান প্রতিপালন) নবুওতের অহর্নিশি সংগ্রামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো না। ৪. আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর অসহনীয় বোঝা চাপিয়ে দেন না।
উপসংহার:
নবুওত একটি বিশেষ দায়িত্ব, কিন্তু সবচেয়ে বড় সম্মান হলো আল্লাহর নৈকট্য। হযরত মরিয়ম ও হযরত ফাতিমা (সা.আ.) প্রমাণ করেন—নারী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাঁদের এমন মর্যাদা দিয়েছেন যা লক্ষ লক্ষ পুরুষের ভাগ্যেও জোটেনি।
আল্লাহর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের সামনে আমরা যা জানি তা সাগরের এক ফোঁটা মাত্র। তিনি যেভাবে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন, তাতে রয়েছে অসীম কল্যাণ ও ভারসাম্য। নারী ও পুরুষ—দুজনেই তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব, শুধু দায়িত্বের রঙ আলাদা, মর্যাদার মাপকাঠি নয়।
﴿وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُكَلِّمَهُ اللَّهُ إِلَّا وَحْيًا أَوْ مِن وَرَاءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولًا﴾ «কোনো মানুষের জন্য এমন নয় যে, আল্লাহ তার সঙ্গে কথা বলবেন—ওহীর মাধ্যমে, অথবা পর্দার আড়াল থেকে, অথবা কোনো রাসূল প্রেরণ করে।» (সূরা শূরা: ৫১)
আল্লাহ যাকে যেভাবে ইচ্ছা সম্মানিত করেন, সেটাই সর্বোত্তম।



