কুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

কেন নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন— আমার মতো কেউ কষ্ট পায়নি?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: এই লেখাটি ব্যাখ্যা করে কেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আমার মতো কেউ এত কষ্ট ভোগ করেনি।” তাঁর নবুয়তের সময়কাল ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার যুগে, যেখানে তিনি এক বিশ্বজনীন দায়িত্ব পালন করেছেন। শত্রু, আত্মীয়, যুদ্ধক্ষেত্র—সব দিক থেকেই তিনি চরম কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন।

ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময়—জাহেলিয়াতের যুগে—একটি বিশ্বজনীন দায়িত্ব নিয়ে মানুষের হেদায়াতের পথে যাত্রা শুরু করেন। তিনি যে পরিমাণ কষ্ট, নির্যাতন ও যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছেন, তা পূর্ববর্তী কোনো নবী ভোগ করেননি।

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই বলেছেন: ما أُوذِيَ نَبِيٌّ مِثْلَ مَا أُوذِيتُ

আমার মতো কোনো নবীকে এত কষ্ট দেওয়া হয়নি।” এই বাণী বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে যেমন কাশফুল গুম্মাআল-মানাকিব-এ উল্লেখ আছে। এমনকি ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-ও বলেছেন:

 إِذَا أُصِبْتَ بِمُصِيبَةٍ، فَاذْكُرْ مُصَابَكَ بِرَسُولِ اللَّهِ (ص)، فَإِنَّ الْخَلْقَ لَمْ يُصَابُوا بِمِثْلِهِ قَطُّ

যদি কোনো বিপদে পড়ো, রাসুলের (সা.) বিপদ স্মরণ করো, কারণ তাঁর মতো কেউ বিপদে পড়েনি।

নবুয়তের ২৩ বছরের সংগ্রাম:

যদিও নবুয়তের সময়কাল ছিল মাত্র ২৩ বছর, এই সময়েই তিনি সবচেয়ে বেশি কষ্ট সহ্য করেছেন। হযরত নূহ (আ.)-এর দীর্ঘ জীবন, ইব্রাহিম (আ.), যাকারিয়া (আ.)-এর কষ্টের তুলনায়ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কষ্ট ছিল বেশি। শুধু মদিনায় ১০ বছরে ৮০টিরও বেশি যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তিনটি ভারী দায়িত্ব

১. অন্ধকার ও অজ্ঞতার মাঝে উম্মতের হেদায়াতের দায়িত্ব

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবজাতিকে আলোর পথে導 করা। যেমন, একজন যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দেখাশোনার দায়িত্ব পায়, আর অন্যজন একটি শিশুর, তাহলে প্রথমজনের দায়িত্ব অনেক বেশি জটিল ও চাপযুক্ত হয়। ঠিক তেমনই, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর দায়িত্ব ছিল মানবজাতির পূর্ণতা অর্জনের পথ দেখানো, এমন একটি দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা যা কিয়ামত পর্যন্ত চলবে।

এই দায়িত্ব এতই ভারী ছিল যে পাহাড়ও তা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি এমন এক সমাজে এই দায়িত্ব পালন করেছেন, যেখানে জাহেলিয়াতের অন্ধকার ছিল গভীর—মানুষ তাঁকে জাদুকর, পাগল বলেছে, শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছে। তাঁর জ্ঞান, কর্ম ও ধৈর্য এই দায়িত্বকে আরও কঠিন করে তুলেছিল।

২. প্রকাশ্য ও গোপন শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দ্বিতীয় দায়িত্ব ছিল কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। মুনাফিকরা ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক—তারা মুসলমানের ছদ্মবেশে ইসলাম ধ্বংসের চেষ্টা করত। তারা কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে ষড়যন্ত্র করত। এমনকি তাঁর জীবননাশের চেষ্টাও করেছে।

এই গোষ্ঠী ইসলামকে মেনে নিতে বাধ্য হলেও অন্তরে ছিল ঘৃণা ও বিদ্বেষ। তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক সংগ্রাম করতে হয়েছে।

৩. ভবিষ্যতের উম্মতের দুঃখ জানার যন্ত্রণা

রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর অনুমতিতে ভবিষ্যতের ঘটনাগুলো জানতেন। তিনি জানতেন, তাঁর কন্যা ফাতিমা (আ.)-কে কষ্ট দেওয়া হবে, আহলে বাইতের ওপর অত্যাচার হবে, উম্মত তাঁর আদর্শ থেকে সরে যাবে। এই জ্ঞান তাঁর হৃদয়ে গভীর যন্ত্রণা সৃষ্টি করত।

তিনি জানতেন, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের ওপর জুলুম হবে, অথচ তিনি তাদের হেদায়াতের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর একমাত্র চাওয়া ছিল আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা, কিন্তু তা ফিরিয়ে দেওয়া হয় অত্যাচার ও অবহেলার মাধ্যমে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন একমাত্র নবী যিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। কোরআনে বলা হয়েছে:

وما أرسلناك إلا كافّة للناس بشیراً و نذیراً

আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।” সূরা সাবা, আয়াত ২৮

তাঁর নবুয়ত এমন এক যুগে এসেছিল, যেখানে সমাজ ছিল নৈতিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত—বেটি হত্যা, গোষ্ঠীগত যুদ্ধ, এবং অশ্লীলতা ছিল সাধারণ। এই সমাজে তাওহিদ ও নৈতিকতা প্রচার করতে গিয়ে তিনি চরম প্রতিরোধের সম্মুখীন হন:

১.তাঁকে পাগল ও জাদুকর বলা হয়

২.তায়েফে পাথর মারা হয়

৩.তিন বছর শিবে আবু তালিবে অবরুদ্ধ থাকেন

৪.হত্যার হুমকি পান

৫.আত্মীয়দের কাছ থেকেও অবহেলা পান

৬.মদিনায় ১০ বছরে ৮০টির বেশি যুদ্ধ পরিচালনা করেন

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হযরত ঈসা (আ.)-এর পর প্রায় ৫৭০ বছর কোনো নবী আসেননি। এই দীর্ঘ বিরতি মানবজাতিকে শিরক ও মূর্তিপূজার দিকে ঠেলে দেয়। এই অবস্থায় নবুয়তের দায়িত্ব গ্রহণ ছিল সবচেয়ে কঠিন।

সূত্র:

১. কুরআনে কারিম /

২. কাশফুল গুম্মা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৩৭; আল-মানাকিব, ইবন শহরআশুব, খণ্ড ৩

৩. আল-কাফি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২২০

আরও পড়ুুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button