কেন কিছু নবীকে «উলুল আযম» বলা হয় ?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন । প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির:কুরআনে «উলুল আযম» শব্দটি একবারই এসেছে, এবং এটি এমন নবীদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যাদের ছিল দৃঢ় সংকল্প ও অটল ইচ্ছাশক্তি আল্লাহর মহান দায়িত্ব পালনের জন্য। এই পরিভাষা ধর্মীয় ও তাফসিরি গ্রন্থে গভীর তাৎপর্য বহন করে, যা মানবজাতিকে পথনির্দেশের ক্ষেত্রে এ নবীদের বিশেষ ভূমিকা ও মর্যাদা তুলে ধরে।
কুরআনে «উলুল আযম» শব্দ
কুরআনে «উলুল আযম» শব্দটি একবার এসেছে। আল্লাহ বলেন:
«فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُل…»
— “তুমি ধৈর্য ধারণ করো, যেমন রাসুলদের মধ্য থেকে উলুল আযমরা ধৈর্য ধারণ করেছিলেন…” (সূরা আহকাফ, ৩৫)।
আযম’ শব্দের অর্থ
১. আভিধানিক অর্থে দিক থেকে: দৃঢ় ইচ্ছা ও অটল সিদ্ধান্ত।
২. শরঈ দিক থেকে: আল্লাহর দায়িত্ব পালনে স্থির সংকল্প ও ধৈর্য।
৩. কখনো কুরআনে «আযম» ধৈর্যের অর্থে এসেছে, কখনো এসেছে অঙ্গীকার পূরণের অর্থে।
«উলুল আযম» (أُولُوا الْعَزْمِ) শব্দটি দুটি অংশে বিভক্ত:
أُولُوا (উলু) → যার মানে হলো অধিকারী, মালিক, যাঁদের আছে।
(এটি আরবিতে বহুবচন, একবচন হলো ذو অর্থাৎ ‘অধিকারী/যার আছে’।)[1]
العَزْم (আযম) → এর আভিধানিক অর্থ হলো দৃঢ় সংকল্প, অটল ইচ্ছাশক্তি, স্থির সিদ্ধান্ত।[2]
তাফসিরে উলুল আযমের ব্যাখ্যা
তাফসির গ্রন্থগুলোতে বলা হয়েছে: যেসব নবী নতুন শরিয়ত ও স্বতন্ত্র ধর্ম নিয়ে এসেছেন, তাঁরা অধিকতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তাই তাঁদেরকে সেই দায়িত্ব পালনে শক্তিশালী সংকল্প ও অটল ধৈর্যের প্রয়োজন ছিল। এই কারণেই তাঁদেরকে «উলুল আযম» বলা হয়েছে। যদিও কেউ কেউ «আযম» শব্দকে «হুকুম» বা «শরিয়ত» এর অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আভিধানিক অর্থে «আযম» মানে শরিয়ত নয়।
সুতরাং, নবী উলুল আযম হওয়ার মানেই হলো তিনি নিজস্ব শরিয়ত ও ধর্ম নিয়ে এসেছেন, এবং তাঁর সমসাময়িক বা পরবর্তী নবীগণকে সেই ধর্ম প্রচার করতে হয়েছে—যতক্ষণ না নতুন শরিয়তসহ অন্য কোনো নবী প্রেরিত হন।
কুরআনে শরিয়তপ্রাপ্ত নবীদের উল্লেখ
আল্লাহ কুরআনে শরিয়তের প্রসঙ্গ এনেছেন এবং চারজন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন (রাসুলুল্লাহ ﷺ ছাড়া), যাঁরা স্বতন্ত্র ধর্ম ও শরিয়তপ্রাপ্ত ছিলেন:
«তিনি তোমাদের জন্য সেই ধর্ম নির্ধারণ করেছেন, যা নূহকে দিয়েছিলেন, এবং যা আমি তোমাকে (হে মুহাম্মদ) ও ইবরাহিম, মূসা ও ঈসাকে(আ.)ওসিয়াত করেছিলাম, যে তোমরা ধর্ম প্রতিষ্ঠা করবে এবং এতে বিভক্ত হবে না…» (সূরা শূরা, ১৩)।
মুফাসসির ও রেওয়ায়েতসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি
যদিও প্রাচীন যুগের কিছু অ-শিয়া মুফাসসির মনে করতেন, উলুল আযম নবী তাঁরা, যারা জিহাদে প্রেরিত হয়েছেন বা তাঁদের মুকাশাফাত প্রকাশ করেছেন। কেউ তাঁদের মধ্যে নূহ, ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ, আইউব বা নূহ, ইবরাহিম, হুদ এবং মুহাম্মদ ﷺ-এর নাম উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু আহলে বাইতের রেওয়ায়েতগুলোতে স্পষ্টভাবে উলুল আযম নবীদের বৈশিষ্ট্য ও তাঁদের সঠিক পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে।
রেওয়ায়েতে উলুল আযম নবীদের বৈশিষ্ট্য
১.তাঁদের দাওয়াত ছিল সর্বজনীন, মানব ও জিন উভয়ের জন্য।
২.তাঁরা স্বতন্ত্র শরিয়ত ও নতুন ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন।
৩.তাঁদের ছিল আসমানি কিতাব।
এই তিনটি বৈশিষ্ট্য—সর্বজনীন দাওয়াত, নতুন ধর্ম, এবং আসমানি কিতাব—উলুল আযম নবীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম রেজা (আ.)-এর দৃষ্টিতে উলুল আযম নবীদের শর্ত
ইমাম সাদিক (আ.)-এর এক বর্ণনায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্ত একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, যা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে যথেষ্ট: কেন কিছু নবী কিতাব থাকা সত্ত্বেও উলুল আযম ছিলেন না? ইমাম রেজা (আ.)-কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো—এই নবীগণ কীভাবে উলুল আযম হলেন? তিনি উত্তর দিলেন: “কারণ নূহ, ইবরাহিম প্রমুখ নবীরা কিতাব ও স্বতন্ত্র শরিয়ত নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন।”
সুতরাং, কিতাব থাকা উলুল আযম নবীদের একটি শর্ত। তবে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত আছে:
১.তাঁদের দাওয়াত মানব ও জিন—সবার জন্য সর্বজনীন ছিল।
২.তাঁরা স্বতন্ত্র ও নতুন শরিয়ত নিয়ে এসেছিলেন।
এখানে লক্ষণীয় যে, স্বতন্ত্র শরিয়ত মানে আগের শরিয়তের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্য নয়; বরং সময় ও পরিস্থিতির প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিটি শরিয়তের কিছু ভিন্নতা ছিল। এটি ছিল স্বাভাবিক বিষয়।
কেন হযরত দাউদ (আ.) উলুল আযম নন?
যদিও হযরত দাউদ (আ.)-এর একটি আসমানি কিতাব ছিল, কিন্তু তাঁর কিতাবটি নতুন শরিয়তের বিধানসমূহ বহন করত না। যেমন হযরত আদম, শীথ ও ইদ্রিস (আ.)-এরও কিতাব ছিল, তবে তাঁরা উলুল আযম নবী হিসেবে গণ্য হননি।
বর্ণনায় উলুল আযম নবীদের নাম
রেওয়ায়েতে স্পষ্টভাবে উলুল আযম নবীদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন (আ.) থেকে বর্ণিত:উলুল আযম নবী পাঁচজন:
১.হযরত নূহ (আ.)
২.হযরত ইবরাহিম (আ.)
৩.হযরত মূসা (আ.)
৪.হযরত ঈসা (আ.)
৫.হযরত মুহাম্মদ (সা.)
একই বিষয় ইমাম সাদিক (আ.) ও ইমাম রেজা (আ.)-এর থেকেও বর্ণিত হয়েছে।
উলুল আযম নবীদের আসমানি কিতাব
১- হযরত নূহ (আ.) ও ইবরাহিম (আ.)-এর কিতাবকে সুহুফ (صحف) বলা হয়েছে।
২- কুরআনে হযরত মূসা (আ.)-এর কিতাবকেও কখনো সুহুফ বলা হয়েছে, যদিও মোট গ্রন্থটিকে বলা হয় তাওরাত।
৩- হযরত ঈসা (আ.)-এর কিতাব ইঞ্জিল।
৪- হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কিতাব হলো কুরআন।
সারমর্ম: উলুল আযম নবী হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত হলো—(১) আসমানি কিতাব, (২) সর্বজনীন দাওয়াত, (৩) স্বতন্ত্র শরিয়ত। এ শর্ত পূরণ করেছেন নূহ, ইবরাহিম, মূসা, ঈসা ও মুহাম্মদ (সা.)।
পাদটীকা
১.সূরা আহকাফ, আয়াত ৩৫।
২.রাগেব এসফাহানী, মুফরাদাত আলফাযুল কুরআন, শব্দ: «عزم»।
৩.«و أُولُو العَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ: الذینَ عَزَمُوا علی أَمرِ الله فیما عَهِدَ إلیهم»
(অর্থ: উলুল আযম রাসূলগণ তাঁরা, যারা আল্লাহ তাঁদের প্রতি যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, তাতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন)।
ইবন মানযূর, লিসানুল আরব, খণ্ড ১২, পৃ. ৩৯৯।
৪.সূরা আশ-শূরা, আয়াত ৪৩।
৫.সূরা তোহা, আয়াত ১১৫।
৬.আল্লামা তাবাতাবায়ী বলেছেন: আযম শব্দের অর্থ «عزیمت» তথা হুকুম ও শরিয়ত—এ ব্যাখ্যা আহলে বাইতের রেওয়ায়েত দ্বারা সমর্থিত।
তাবাতাবায়ী, সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হুসাইন, আল–মীযান ফি তাফসিরিল কুরআন, খণ্ড ১৯, পৃ. ২১৯, কুম: দাফতারে এন্তেশারাতে ইসলামি, ৫ম সংস্করণ, ১৪১৭ হিজরি।
৭.মাকারেম শিরাজি, নাসের, তাফসিরে নমুনা, খণ্ড ২১, পৃ. ৩৭৮, তেহরান: দারুল কুতুবুল ইসলামিয়া, প্রথম সংস্করণ, ১৩৭৪ শামসি।
৮.মিসবাহ ইয়াজদি, মুহাম্মদ তাকি, ওসূলে আ‘কায়েদ, পৃ. ২৩৯, তেহরান: সাযমানে তাবলীগাতে ইসলামি, ৪র্থ সংস্করণ, ১৩৭৯ শামসি।
৯.সূরা আশ-শূরা, আয়াত ১৩।
১০.মাজলিসি, মুহাম্মদ বাকির, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১১, পৃ. ৩৫, বৈরুত: দার ইহইয়ায়ে তুরাসিল আরাবি, ২য় সংস্করণ, ১৪০৩ হিজরি।
১১.একই সূত্র, পৃ. ৩৩।
১২.একই সূত্র, পৃ. ৩৪; শাইখ সদূক, ইলালুশ শরায়ি‘, খণ্ড ১, পৃ. ১২২–১২৩, ১০১ বাব, কুম: কেতাব ফরুশি দাওরী, প্রথম সংস্করণ, ১৩৮৫ শামসি।
১৩.বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১১, পৃ. ৩৫।
১৪.একই সূত্র, পৃ. ৫৬।
১৫.আল–মীযান ফি তাফসিরিল কুরআন, খণ্ড ২, পৃ. ১৪২।
১৬.কুমি, আলী ইবনে ইব্রাহিম, তাফসিরুল কুমি, গবেষক ও সংশোধক: মুসাভী জাযায়েরি, সাইয়্যেদ তাইয়্যিব, খণ্ড ২, পৃ. ৩০০, কুম: দারুল কিতাব, ৩য় সংস্করণ, ১৪০৪ হিজরি; বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১১, পৃ. ৩২।
১৭.বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১১, পৃ. ৫৬।
১৮.ইলালুশ শরায়ি‘, খণ্ড ১, পৃ. ১২২–১২৩, ১০ বাব, ১।
১৯.সূরা আ‘লা, আয়াত ১৯।
[1] রাগেব (মুফরাদাত) বলেছেন: আযম মানে হলো কোনো কাজ করার জন্য দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
[2] লিসানুল আরব অভিধানে এসেছে: আযম মানে হলো আল্লাহর আদেশ পালনে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি নেওয়া।