কেন কখনও নিজের লোকদের কাছেও তাকিয়া জরুরি হয়?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ইসলামিক জীবন ও আচার-ব্যবহারের মধ্যে তাকিয়া বা ধর্মীয় গোপনীয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। অনেক সময় আমরা ভাবি, তাকিয়া শুধু শত্রু বা বাইরের মানুষদের সঙ্গে প্রয়োজন হয়। তবে ইতিহাস ও হাদিসের আলোকে দেখা যায়—কখনও কখনও আমাদের নিজের পরিচিত, এমনকি নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যেও সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এবং মরহুম আয়াতুল্লাহ বুরুজার্দীর স্মৃতিচারণা এ বিষয়ে আলোকপাত করে।
১. তাকিয়ার প্রয়োজন শুধুই বাইরের জন্য নয়
মরহুম আয়াতুল্লাহ বুরুজার্দী (রহ.) একবার স্মরণ করেছিলেন, ইমাম সাদিক (আ.) কখনও কখনও নিজের শিয়াদের কাছেও তাকিয়া করতেন। কারণ—তাদের উদ্দেশ্য সর্বদা সত্য সন্ধান ছিল না, বরং কখনও কখনও তারা এমন প্রশ্ন তুলতেন যা ফিতনা সৃষ্টি করতে পারে।
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন:
যখন আমার পিতার কাছে মানুষ আসতেন, তাদের উদ্দেশ্য ছিল সত্য জানার এবং তা অনুযায়ী কাজ করার। কিন্তু যারা এখন আসে, তাদের উদ্দেশ্য শুধুই জানতে চাওয়া বা শুনে তা ছড়িয়ে দেওয়া—যা বিভ্রান্তি ও ফিতনার কারণ হতে পারে। তাই আমি বাধ্য হয়ে তাকিয়ার মাধ্যমে উত্তর দিতে হয়।”
فَإِنَّ الشِّيَعَةَ الَّذِينَ يَأْتُونَ إِلَى أَبِي يَأْتُونَ بِخُلُوصِ النِّيَّةِ وَالْقَصْدِ لِمَا هُوَ الْحَقُّ، وَأَمَّا هَؤُلَاءِ فَيَأْتُونَ إِلَيَّ لِمَا يُسَمِّعُونَ وَيُذِيعُونَ وَيُفْتِنُونَ
এই উদ্ধৃতিটি প্রমাণ করে, নিজেদের লোকদের মধ্যেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন, কারণ কখনও কখনও অভ্যন্তরীণ প্রশ্নই সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে।
২. অভ্যন্তরীণ তাকিয়ার চ্যালেঞ্জ
মরহুম বুরুজার্দী (রহ.) বলেন:
আপনজনের কাছ থেকে তাকিয়া করা কখনও কখনও সবচেয়ে জরুরি। প্রথমে আমি ভাবতাম, আমার ফতোয়া অনুযায়ী মানুষ কাজ করবে। কিন্তু দেখলাম, কিছু মানুষ নিজের স্বাদ ও খেয়ালের অনুসারী—ফতোয়া মেনে চলে না। তাই কখনও কখনও সতর্কতা প্রয়োজন।
فِي أَوَّلِ مَرْجَعِي كُنْتُ أَظُنُّ أَنَّ النَّاسَ يَعْمَلُونَ بِفَتَوَايَ وَأَنَّهُمْ يَتَّبِعُونَ الرِّضَا وَذَوْقَهُمْ فِي الْأَحْكَامِ، وَلَكِنْ بَعْدَ بَعْضِ الْفَتَوَى أَدْرَكْتُ أَنَّ الْوَاقِعَ غَيْرُ ذَلِكَ
এখানে স্পষ্ট যে নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেও কখনও কখনও সত্যকে সরাসরি প্রকাশ করা বিপজ্জনক হতে পারে।
৩. তাকিয়ার উদ্দেশ্য ও নৈতিক শিক্ষা
তাকিয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো—ইসলামের সুরক্ষা ও শান্তি বজায় রাখা, বিভ্রান্তি ও ফিতনা রোধ করা। এটি কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং সমাজ ও ধর্মীয় সম্প্রদায়কে রক্ষা করার একটি নৈতিক কর্তব্য।
ইমাম সাদিক (আ.) এবং বুরুজুর্দীর উদাহরণ আমাদের শিক্ষা দেয়, যে কখনও কখনও সতর্কতার সঙ্গে সত্য উপস্থাপন করা ও প্রয়োজনীয় সীমা মেনে কথা বলা ধর্মীয় দায়িত্বের অংশ।
উপসংহার
তাকিয়া শুধুমাত্র শত্রুর প্রতি নয়, কখনও কখনও নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রয়োজন হয়।
১.এটি বিভ্রান্তি ও ফিতনা প্রতিরোধ করে।
২.এটি সত্যকে রক্ষা করে এবং সমাজে শান্তি বজায় রাখে।
৩.এটি মুমিনদের নৈতিক ও দায়িত্বপরায়ণ আচরণের অংশ।
ইমাম সাদিক (আ.) এবং আয়াতুল্লাহ বুরুজার্দীর স্মৃতিচারণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ধর্মীয় সতর্কতা ও নৈতিক দায়িত্ব কখনও কখনও ব্যক্তিগত আন্তরিকতার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। সত্যকে প্রকাশ করার সাহস থাকা দরকার, কিন্তু একই সঙ্গে সমাজ ও ধর্মের কল্যাণের জন্য কখনও গোপনীয়তা বজায় রাখাও অপরিহার্য।
সূত্র:ওস্তাদ মোতাহারী দাহ গুফতোর,পৃষ্ঠা ৩০৪–৩০৫।



