কেন আমাদের সন্তানদের লালন-পালন সুদূরপ্রসারী ও স্থায়ী হয় না?
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির সন্তানের অন্তর আলোকিত না করে কেবল বাহ্যিক পরিবর্তন আরোপ করা কখনোই স্থায়ী ফল বয়ে আনে না; মানুষের চিন্তা, উপলব্ধি ও ভালোবাসার গভীর স্তর থেকে প্রকৃত লালন-পালনের সূচনা ঘটে।
আধুনিক সমাজে অভিভাবকরা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে, বহু চেষ্টা ও ত্যাগ সত্ত্বেও সন্তানদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশীলন বা আচরণগত শৃঙ্খলা দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকে না। এর মূল কারণ হলো—লালন-পালনের ক্ষেত্রে আমরা অধিকাংশ সময় বাহ্যিক রূপ ও আচরণকে অগ্রাধিকার দিই, কিন্তু সন্তানের অন্তর্জগৎ, চিন্তাধারা ও মানসিক গঠনকে উপেক্ষা করি।
প্রকৃত লালন-পালন মানুষের ভেতর থেকেই শুরু হয়। কোনো আচরণ তখনই স্থায়ী হয়, যখন তা বিশ্বাস, উপলব্ধি ও আন্তরিক ভালোবাসার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম, ভয় দেখানো শাসন কিংবা কেবল পুরস্কার ও শাস্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা অভ্যাস সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল হয়ে পড়ে।
অনেক সময় আমরা শুধু বাহ্যিক পরিবর্তনের দিকে মনোযোগ দিই—কারও পোশাক বদলাই, তাকে নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচরণে অভ্যস্ত করি, নামাজ বা অন্যান্য ইবাদতে বাধ্য করি কিংবা উপদেশ, স্লোগান, প্রশংসা ও হুমকির মাধ্যমে তাকে একটি কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু যদি তার হৃদয়ে বিশ্বাসের আলো জ্বলে না ওঠে, যদি সে নিজে থেকে সেই পথকে ভালোবাসতে না শেখে, তবে পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই আচরণও ম্লান হয়ে যায়। ঠিক যেমন উত্তপ্ত লোহা নতুন পরিবেশে গেলে ধীরে ধীরে ঠান্ডা ও শক্ত হয়ে পড়ে।
মানুষ গড়া ও সন্তানদের লালন-পালনের প্রকৃত কাজ শুরু করতে হয় অন্তরের গভীরতা থেকে। আমরা যখন কারও আচরণ, কথাবার্তা কিংবা বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন করতে চাই, তখন তার আগেই তার চিন্তা, জ্ঞান, বিশ্বাস ও আগ্রহকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। কারণ মানুষের চিন্তা থেকে জন্ম নেয় জ্ঞান, জ্ঞান থেকে জন্ম নেয় ভালোবাসা এবং সেই ভালোবাসাই শেষ পর্যন্ত তার কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। আচরণ তাই অন্তরেরই প্রতিফলন।
এ কারণেই স্থায়ী ও কার্যকর লালন-পালনের জন্য প্রয়োজন ভয়ের শাসন নয়, বরং বোঝাপড়া, সংলাপ ও ভালোবাসা। সন্তানদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে হবে, তাদের চিন্তা ও অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সত্যের সৌন্দর্য তুলে ধরতে হবে। যখন সন্তানের হৃদয়ে সত্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়, তখন সে নিজ উদ্যোগেই সেগুলো আঁকড়ে ধরে।
অতএব, সন্তানের চরিত্র গঠন ও নৈতিক শিক্ষায় সফল হতে চাইলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। বাহ্যিক নিয়ম ও আচরণের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে অন্তরের জাগরণ, চিন্তার বিকাশ ও ভালোবাসার বীজ বপনের ওপর। কারণ স্থায়ী পরিবর্তন কখনো বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না—তা জন্ম নেয় ভেতর থেকে।
সূত্র: দায়িত্ব ও আত্মগঠন (মূল গ্রন্থ: মাসউলিয়াত ও সাযান্দেগি), পৃষ্ঠা ৪৪



