কুরআন, হাদীস ও শিয়া তত্ত্বের প্রেক্ষিতে রাজআত: একটি গবেষণামূলক সাহিত্য-পর্যালোচনা
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: রাজআত শুধু একটি ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা নয়, বরং শিয়া চিন্তাধারার গভীর আধ্যাত্মিক প্রতীক। এর ব্যাখ্যা কুরআন, হাদীস ও ইতিহাসে যেমন রয়েছে, তেমনি সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি মানুষের অন্তরের আশা, ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা এবং ঈমানের বিজয়ের প্রতিচ্ছবি।
শব্দার্থের সাহিত্যিক রূপ
১.“রাজআত” মানে ফিরে আসা।
২.সাহিত্যিকভাবে এটি হলো আশার পুনর্জন্ম—যেখানে হারিয়ে যাওয়া আলো আবার ফিরে আসে।
৩.এটি মানুষের অন্তরে সেই বিশ্বাস জাগায় যে, অন্যায়ের অন্ধকার একদিন ভেঙে যাবে এবং সত্যের আলো পুনরায় উদ্ভাসিত হবে।
পরিভাষার সাহিত্যিক ব্যাখ্যা
১. শিয়া কলামশাস্ত্রে রাজআত হলো কিয়ামতের আগে একটি বিশেষ প্রত্যাবর্তন।
২. সাহিত্যিকভাবে এটি যেন দুনিয়া ও আখিরাতের মাঝখানে দাঁড়ানো এক সেতু—যেখানে ন্যায়বিচার ও প্রতিশোধের মিলন ঘটে।
৩. রাজআত হলো আলোর পুনরাগমন এবং অন্ধকারের পতন।
রাজআতের স্থান ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্য
১- কুরআনের কাহিনী: বনী ইসরাইলের জীবিত হওয়ার ঘটনাগুলো সাহিত্যিকভাবে মানুষের অন্তরে পুনর্জাগরণের প্রতীক।
২- ইমাম আলীর যুগ: সাহাবীদের রাজআতের বিশ্বাস যেন ইতিহাসের পাতায় লেখা এক আধ্যাত্মিক কবিতা।
৩- শিয়া আলেমদের ঐক্যমত: তাদের রচনায় রাজআত শুধু যুক্তি নয়, বরং আধ্যাত্মিক মহাকাব্য—যেখানে সত্যের বিজয় ও মিথ্যার পতনকে চিত্রিত করা হয়েছে।
সাহিত্যিক তাৎপর্য
১.রাজআত হলো ন্যায়বিচারের নাটকীয় প্রত্যাবর্তন।
২.এটি মানুষের অন্তরে অপেক্ষার কবিতা—যেখানে প্রিয়জনেরা ফিরে আসে, শত্রুরা ন্যায়বিচারের মুখোমুখি হয়।
৩.সাহিত্যে রাজআতকে দেখা যায় আশার প্রতীক হিসেবে—যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শিয়াদের হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।
রাজআতের কুরআনভিত্তিক প্রমাণ
যদিও “রাজআত” শব্দটি কুরআনে পরিভাষাগতভাবে ব্যবহৃত হয়নি, তবু কুরআন এমন বহু দৃষ্টান্তে সমৃদ্ধ যা প্রাক্-কিয়ামত বিশেষ প্রত্যাবর্তনের ধারণাকে সমর্থন করে। এই নজিরগুলিই শিয়া ইমামিয়া আকীদায় রাজআত বিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।
১. কুরআনে “নির্বাচিত পুনরুত্থান”—সূরা নমল, আয়াত ৮৩
﴿وَیَوْمَ نَحْشُرُ مِن کُلِّ أُمَّةٍ فَوْجًا مِّمَّن یُکَذِّبُ بِآیَاتِنَا فَهُمْ یُوزَعُونَ﴾ (نمل: ۸۳)
আয়াতটিতে বলা হয়েছে—একসময় প্রতিটি সম্প্রদায় থেকে একটি করে দলকে পুনরুত্থান করা হবে। আল্লামা তাবাতাবায়ী (রহ.)-সহ বহু শিয়া মুফাসসিরের মতে, এই “নির্বাচিত দলগত পুনরুত্থান” কিয়ামতের সাধারণ হাশরের কথা নয়; বরং এটি রাজআত-পর্বে ঘটবে।
২. বনী ইসরাইলের মৃতদের পুনর্জীবন
﴿فَقُلْنَا اضْرِبُوهُ بِبَعْضِهَا ۚ کَذَلِکَ یُحْیِ اللَّهُ الْمَوْتَیٰ﴾(বাকারা: ৭৩)
এ আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেন—এভাবেই তিনি মৃতদের পুনরুজ্জীবিত করেন। এটি দুনিয়াতে মৃত্যুর পর পুনর্জীবনের এক সুস্পষ্ট উদাহরণ, যা রাজআতের সম্ভাবনাকে বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত করে।
৩. হযরত ঈসা (আ.)–এর যুগে মৃতদের পুনর্জীবন
কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী, হযরত ঈসা (আ.)-এর অন্যতম মু‘জিযা ছিল—মৃতকে জীবিত করে তোলা। এই নজির সরাসরি প্রমাণ করে যে, আল্লাহর ইচ্ছায় দুনিয়ায় পুনরুজ্জীবন সম্পূর্ণ সম্ভব্য।
৪. আশহাবে কাহফের জাগরণ
দীর্ঘ শতাব্দী নিদ্রার পর আবার জেগে ওঠা— এটিও মৃত্যুর অনুরূপ অবস্থা থেকে দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তনের শক্তিশালী কোরআনিক উদাহরণ।
৫. উযায়ের (আযীর)–এর শতবর্ষ পরে পুনর্জীবন
কুরআন স্পষ্ট ভাষায় বলছে—উযায়ীরকে আল্লাহ একশ বছর পর পুনরায় জীবিত করেছেন। এটি রাজআতের নীতি—”মৃত্যুর পর সীমিতদৈর্ঘ্যের দুনিয়াবি প্রত্যাবর্তন”—কে আরও সুস্পষ্ট করে তুলে ধরে। ইমাম সাদিক (আ.)–এর বাণী: ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন: কুরআনে এমন কোনো আয়াত নেই যা রাজআতের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, অথচ তার অনুরূপ ঘটনা পূর্ববর্তী উম্মতগুলোর মধ্যে ঘটেনি।
(الغیبة للنعمانی، ص ۱۵৩) অর্থাৎ, কুরআন বারবার দেখিয়েছে—আল্লাহ চাইলে দুনিয়াতে পুনর্জীবন কোনো অসম্ভব ঘটনা নয়; বরং ঐশী বিধানেরই একটি ধারাবাহিক প্রকাশ।
রাজআত—হাদীসসমূহে সবচেয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের স্তম্ভ
রাজআতসংক্রান্ত হাদীস শিয়া ঐতিহ্যে অতি-বহুল, প্রামাণ্য ও পরস্পর-সমর্থিত (মুত্তাওয়াতির) হিসেবে বিবেচিত। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শিয়া হাদীসগ্রন্থগুলোতে এ বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে।
প্রধান সূত্রসমূহ
১. আল-কাফী লেখক: শায়খ কুলাইনী (রহ.) এ কিতাব যেন ইমাম সাদিক (আ.)-এর হৃদয়ের আয়না। প্রতিটি পাতায় রাজআতের হাদীস এমন ঝলমল করে যে, পড়তে পড়তে মনে মনে হয়—ইমাম নিজে এসে কানে কানে বলছেন: “আমরা ফিরে আসব, হে শিয়ারা! অপেক্ষা করো।
২. আল-ই‘তিকাদাত লেখক: শায়খ সদূক (রহ.) এই ছোট্ট কিতাবটি যেন একটি হীরের টুকরো। সংক্ষেপে, কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলে গেছে: “রাজআত আমাদের দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে তা অস্বীকার করে, সে যেন আহলে বাইতের ভালোবাসা থেকে দূরে সরে গেল।
৩. তাশীহুল ই‘তিকাদ লেখক: শায়খ মুফীদ (রহ.) যেন একটি তরবারি—যা সন্দেহের গলা কেটে রাজআতের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে। প্রতিটি যুক্তি এত তীক্ষ্ণ যে, সত্যের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
৪. আল-আমালী লেখক: শায়খ তূসী (রহ.) মজলিসের সেই স্মৃতিময় রাতগুলোর সাক্ষী। যখন শেখ তূসী ইমামদের হাদীস পড়তেন আর শ্রোতারা কাঁদত। রজনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, “রাজআত কি সত্যি হবে?” শেখ তূসী চোখ তুলে বললেন, যেদিন হোসাইনের পতাকা উড়বে, সেদিন তুমি নিজে দেখবে।
৫. বিহারুল আনওয়ার লেখক: আল্লামা মাজলিসী (রহ.) এ যেন রাজআতের এক বিশাল সমুদ্র। ১১০ খণ্ডের মধ্যে ৫৩তম খণ্ড পুরোটাই রাজআতের জন্য উৎসর্গ করা। হাজার হাজার হাদীস একত্র করে মাজলিসী যেন বলে গেছেন: “এত প্রমাণের পরও যদি কেউ সন্দেহ করে, তবে তার হৃদয়ে নয়, চোখে সমস্যা।
হাদীসে রাজআত: কিয়ামতের পূর্বলক্ষণ ও ঈমানদারদের প্রতি এক মহা-অনুগ্রহ
রেওয়ায়েতে রাজআতকে কিয়ামত-পূর্ববর্তী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে মু’মিনদের জন্য বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কারা রাজআত করবে?
১. বিশুদ্ধ ঈমানদারগণ
রেওয়ায়েতে এসেছে: «لَا یَرْجِعُ إِلَّا مَنْ مَحَضَ الْإِیمَانَ مَحْضاً.»
অর্থাৎ—যাদের ঈমান সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নির্মল, কেবল তারাই ফিরে আসবে।
এই ঈমানদাররা হলেন—
১.আহলে বাইত (আ.)–এর সত্যনিষ্ঠ অনুগামী,
২.যারা ইতিহাসজুড়ে অত্যাচার ও নির্যাতনের মধ্যে শহীদ হয়েছেন,
৩.এবং যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুত ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার যুগে জীবিত থাকার সুযোগ পাননি।
২. চরম অবিশ্বাসী ও অহংকারী শত্রুরা
একই রেওয়ায়েতে আরো বলা হয়েছে: «… وَ لَا یَرْجِعُ إِلَّا مَنْ مَحَضَ الْکُفْرَ مَحْضاً.»
অর্থাৎ—যাদের কুফর ও শত্রুতা নিখাদ ও সীমাহীন, তারাও ফিরে আসবে।
তাদের প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্য—
১.দুনিয়াতে আল্লাহর শাস্তির স্বাদ গ্রহণ,
২.এবং তাদের প্রকৃত প্রকৃতি প্রকাশ পেয়ে সম্পূর্ণভাবে লাঞ্ছিত হওয়া।
৩. ইমামদের রাজআত
শিয়া কলামশাস্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো—ইমামদের প্রত্যাবর্তন।
রেওয়ায়েতসমূহে বলা হয়েছে—
১.রাজআতের প্রথম প্রত্যাবর্তনকারী ইমাম হলেন ইমাম হুসাইন (আ.)
২.এরপর ইতিহাসের নির্দিষ্ট পর্যায়ে অন্যান্য ইমামরাও ফিরে আসবেন।
এই প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্য—
১.আল্লাহর ন্যায়ভিত্তিক শাসন সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করা,
২.সত্যকে বিজয়ী করা,
৩.এবং সেই বৈশ্বিক ন্যায়ের যুগকে পূর্ণতা দেওয়া, যার জন্য মানবতা যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করেছে।
৪. মহানবী (সা.)–এর রাজআত
বহু রেওয়ায়েতে এসেছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.)–এরও রাজআত বা প্রত্যাবর্তন ঘটবে।
এই প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্য—
১.বৈশ্বিক ইসলামী শাসনের চূড়ান্ত সমর্থন,
২.আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব ও মিশনের পূর্ণতা,
৩.এবং ন্যায়বিচারের সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ অধ্যায়ে সরাসরি উপস্থিত থাকা।
ইমাম খোমেনী (রহ.)–এর দৃষ্টিতে রাজআত
ইমাম খোমেনী (রহ.) তাঁর তাফসির, আধ্যাত্মিক, ক্যালামিক এবং রাজনৈতিক রচনায় স্পষ্টভাবে রাজআতের বাস্তবতা ও অবশ্যম্ভাবিতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—
১. রাজআত—নিঃসন্দেহ ও স্বীকৃত সত্য
ইমাম খোমেনীর মতে, রাজআত এমন একটি বিশ্বাস যা দৃঢ় রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে এবং আল্লাহর ন্যায়ভিত্তিক শাসনের পূর্ণ বাস্তবায়নের একটি অবিচ্ছেদ্য ধাপ।
২. রাজআত—ঐশী শক্তি ও ইচ্ছার প্রকাশ
ইমামের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণে—
রাজআত হলো—
১.হক ও বেলায়াতের সত্যের প্রকাশ,
২.নূরের বিস্তার,
৩.এবং ঈশ্বরীয় নামসমূহের জাগতিক জগতে উন্মোচন।
৩. রাজআত ও মাহদাভী বিশ্বব্যবস্থা
ইমাম খোমেনী বিশ্বাস করতেন যে পূর্ণ ন্যায়বিচারের যুগ, অর্থাৎ মাহদাভী শাসনের পরিপূর্ণতা, রাজআত ব্যতীত অসম্ভব। কারণ—
১.জুলুমকারীরা দুনিয়াতেই প্রতিফল পায়,
২.এবং মুজাহেদ ও খাঁটি ঈমানদাররা দুনিয়াতেই তাদের প্রতিদান প্রত্যক্ষ করে।
ইমাম খোমেনীর ক্যালামিক সাক্ষ্য ও ফতোয়া
১.কাশফুল আসরার (পৃষ্ঠা ১৭১):
“রাজআত শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্গত; অসংখ্য আয়াত ও রেওয়ায়েত এর সাক্ষ্য বহন করে। যে ব্যক্তি রাজআতকে অস্বীকার করে, সে শিয়া মাযহাবের সীমারেখা অতিক্রম করে যায়।
২.তাহরিরুল আল ওসিলা (খণ্ড ১, কিতাবুত তাহারাত, পৃষ্ঠা ১৬৭, مسئله ৮):
«রাজআত অস্বীকারকারী শিয়া ইমামিয়ার পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন, যদি না তার অস্বীকার অজ্ঞতা বা অযাচিত অনুসরণের ফল হয়.»
৩. জাতিসংঘ-প্রস্তাব গ্রহণের বার্তা (২৯):
আমরা আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করেছি, আল্লাহর জন্যই শান্তি করেছি… ধন্য সেই শহীদরা যারা চলে গেছে; ধন্য তারা যারা টিকে আছে; এবং ধন্য তারা—যারা আবার ফিরে আসবে.(এই বাক্যটি শহীদদের রাজআতের প্রতি ইমামের সবচেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হয়।)
৪. তাঁর বিখ্যাত কবিতায়:
باز آی و دلهای شکسته را مرهمی نه
کز غیبت تو شکستهتر است همه عالمی
ফিরে এসো—ভগ্ন হৃদয়ের উপর রাখো আরোগ্যের হাত, কারণ তোমার অনুপস্থিতির ক্ষত—সমগ্র দুনিয়ার ক্ষতের চেয়েও গভীর।
রাজআতের দার্শনিক ব্যাখ্যা
রাজআত, শিয়া মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস এবং এটি আল্লাহর ন্যায় ও ইতিহাসের প্রতিশোধের পূর্ণতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থাপনা। প্রধান দার্শনিক লক্ষ্যগুলো হলো—
১. ন্যায়বিচারের পূর্ণতা
ইতিহাসে বহু জুলুম ও অবিচার অপরিত্ত হয়েছে। রাজআত একটি সুযোগ দেয় এই পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, যেখানে অন্যায়ের প্রতিদান নিশ্চিত হয়।
২. মাহদাভী বিশ্বব্যবস্থার সহায়তা
রেওয়ায়েত অনুযায়ী, মাহদভীর আবির্ভাবের পরে, বিশ্বের প্রয়োজন হয় সত্যিকারের ইমানদার ও ন্যায়পরায়ণ সাহায্যকারীদের। রাজআত তাদের ফেরত নিয়ে আসে।
৩. হক ও আল্লাহর ক্ষমতার প্রমাণ
রাজআতের মাধ্যমে শত্রুদের পুনরুত্থান ঘটে, যা আল্লাহর অমোঘ শক্তি প্রদর্শন করে এবং তাদের উপর শেষ আলোকপাত বা হক প্রমাণ করে।
৪. আল্লাহর প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা
আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, পৃথিবীকে ন্যায়পরায়ণদের উত্তরাধিকারী করা হবে। রাজআত এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের অংশ।
রাজআত বনাম কিয়ামত
অনেকে রাজআতকে কিয়ামতের সঙ্গে ভুলে ফেলে। তবে তাদের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে:
| বিষয় | রাজআত | কিয়ামত |
| সময় | মাহদির আবির্ভাবের পরে | বিশ্বের অবসান |
| গ্রুপ | খাঁটি ইমানদার ও চরম কাফের | সব মানুষ |
| লক্ষ্য | আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার | চূড়ান্ত বিচারের বিচার |
| জীবনধারা | দুনিয়ায়, কর্ম ও সংগ্রামের সঙ্গে | পরকাল, দায়বদ্ধতা ছাড়া |
শিয়ার বড় বড় আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি
শাইখ মুফিদ
রাজআতকে শিয়াদের প্রয়োজনীয় বিশ্বাসের অংশ বলেছেন: রাজআত শিয়াদের জন্য নিশ্চিত সত্য এবং এতে ঐক্যমতের রয়েছে।
সৈয়দ মর্তজা আলমুলহেদী
রাজআতকে আল্লাহর ন্যায় ও কোরআনের প্রতিশ্রুতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আল্লামা মাজলিসি
‘বিহারুল আনোয়ার’-এ রাজআতের প্রমাণের জন্য বিস্তৃত অধ্যায় ও শতাধিক প্রামাণিক রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন।
আল্লামা তাবাতাবাই
আল-মিজান’-এ রাজআতকে আল্লাহর সুন্নাত ও আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.)–এর রাজআত
বেশ কয়েকটি রেওয়ায়েত নিশ্চিত করে যে, প্রথম রাজআতকারী হবেন সয়্যিদুশ শহাদা ইমাম হুসাইন (আ.)। এর কারণ হলো—
১.অতুলনীয় অবিচার ও শত্রুভুক্তি
২.আল্লাহর বিচারের প্রয়োজন
৩.মাহদাভী বিশ্বব্যবস্থায় বিশেষ ভূমিকা
কিছু রেওয়ায়েত অনুযায়ী, রাজআতের পরে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।
উদ্ভব ও সময়ে রাজআত কিভাবে ঘটে?
১.ইমাম মাহদীর আবির্ভাব – বিশ্বব্যাপী ন্যায় প্রতিষ্ঠা।
২.পৃথিবী থেকে অন্যায় দূরীকরণ – মহাপরিচ্ছেদ যুদ্ধ।
৩.খাঁটি ইমানদারদের রাজআত – সত্যিকারের সহযোদ্ধা ও শহীদদের ফেরত।
৪.চরম কাফেরদের রাজআত – পৃথিবীতে শাস্তি।
৫.ইমামদের রাজআত – খোদায়ী শাসনের সমাপ্তির পর্যায়।
উপসংহার
রাজআত শিয়াদের অন্যতম প্রধান বিশ্বাস, যা ভিত্তি পেয়েছে কোরআন, সুন্নাহ, প্রামাণিক রেওয়ায়েত, বিবেক ও আলেমদের ঐক্য থেকে।
রাজআত নির্দেশ করে—
১- ইতিহাসের সকল অবিচার অমীমাংসিত থাকেনা,
২- সত্যিকারের ইমানদাররা ফিরে আসে,
৩- শত্রুরা অভিযোগমুক্ত ও লজ্জিত হয়,
৪- এবং খোদায়ী শাসন পূর্ণতার দিকে এগোয়।
রাজআত হলো আবির্ভাব এবং কিয়ামতের মধ্যে একটি সেতু, যেখানে:
১.খাঁটি ইমানদাররা ফিরে আসে,
২.শত্রুরা লজ্জিত হয়,
৩.খোদায়ী শাসন পূর্ণতা পায়।



