বিশেষ সংবাদকুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাস

কুরআন ও রিওয়ায়াতের আলোকে: আখেরি যামানায় পরিবারিক সংকট ও করণীয়

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলামী রিওয়ায়াতে আখেরি যামানার নানা ফিতনার কথা এসেছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো পরিবারিক সংকট। সন্তানরা পিতামাতার অবাধ্য ও অসম্মানকারী হয়ে উঠবে, পিতামাতাও সন্তানের প্রতি জুলুম করবে, তালাক ও সম্পর্কচ্ছেদ বেড়ে যাবে এবং পিতামাতার মর্যাদা হ্রাস পাবে। আলেমগণ সতর্ক করেছেন, এ সময় শয়তান সর্বশক্তি দিয়ে পরিবার ও সমাজের ভিত্তি নষ্ট করতে সচেষ্ট থাকবে, তাই পরিবার রক্ষাই হবে ঈমান রক্ষার মূল দায়িত্ব।

পরিবার: মানবসমাজের মূল ভিত্তি

ইসলামে পরিবারকে সমাজ ও সভ্যতার মূল ভিত্তি বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন: وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً “আল্লাহ তোমাদের মাঝে ভালোবাসা ও দয়া স্থাপন করেছেন।” [সূরা রূম: ২১] হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন আলী বলেন, যদি আল্লাহর দ্বীনের জন্য প্রকৃত সৈনিক তৈরি করতে হয় এবং সমাজকে নৈতিক সমাজে রূপান্তর করতে হয়, তবে তার সূচনা পরিবার থেকেই। পরিবারগুলো মোজাইকের টুকরোর মতো, যা মিলিত হয়ে শক্ত ভিত্তির কাঠামো তৈরি করে।

রিওয়ায়াতে আখেরি যামানার সংকেত

ইসলামী রিওয়ায়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে আখেরি যামানায় এমনকি ধর্মীয় সমাজও গভীর ক্ষতির সম্মুখীন হবে। كَثرَةُ العُقوق — অর্থাৎ সন্তানদের অবাধ্যতা ও পিতামাতার প্রতি অসম্মান বৃদ্ধি পাবে। সন্তানরা পিতা-মাতা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করবে না; তাঁদের কষ্ট দেবে, হৃদয় ভাঙবে। অন্যদিকে পিতামাতাও কখনও সন্তানের ব্যক্তিত্ব ভেঙে ফেলবে, যার ফলে তারা “অকৃতজ্ঞ সন্তানের শিকার” হবে। ইমাম সাদিক (আ.) বলেন, «مَلْعُونٌ مَنْ ظَلَمَ وَلَدَهُ» “যে ব্যক্তি তার সন্তানের প্রতি জুলুম করে, সে অভিশপ্ত।” [বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১০৩, পৃষ্ঠা ১১১]

পারস্পরিক অধিকার

ইসলামে পিতা-মাতা ও সন্তানের অধিকার উভয় দিকেই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আমরা সন্তানের অবাধ্যতার কথা শুনি, কিন্তু রিওয়ায়াতে পিতা-মাতার জুলুম সম্পর্কেও সতর্ক করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: “وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُم خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ” “দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না।” [সূরা ইসরা: ৩১] এই আয়াত শুধু শারীরিক হত্যাকাণ্ড নয়, বরং সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান ধ্বংস করার বিরুদ্ধেও সতর্ক করে।

আখেরি যামানার পারিবারিক সংকট

তালাক বৃদ্ধি: দাম্পত্য সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পরিবার ভেঙে পড়বে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হবে: কুরআনে যেটিকে সংরক্ষণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَن يُوصَلَ “তারা হলো তারা যারা সেই সম্পর্ক অটুট রাখে, যা আল্লাহ রক্ষা করার আদেশ দিয়েছেন।” [সূরা রা’দ: ২১] পিতামাতার মর্যাদাহানি: পিতামাতাকে ছোট করে দেখা হবে, তাঁদের সম্মান করা হবে না।

শয়তানের ষড়যন্ত্র

আখেরি যামানার এই সংকটের পেছনে শয়তানের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। শয়তান কোনো কল্পিত বা প্রতীকী চরিত্র নয়, বরং বাস্তব একটি সত্তা, যার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা, কৌশল ও সেনাদল রয়েছে। ইমাম আলী (আ.) বলেছেন: «إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ جَمَعَ جُنُودَهُ وَاسْتَفْرَغَ جُهْدَهُ» “শয়তান তার সৈন্যদের একত্র করেছে এবং সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে।” [নাহজুল বালাগা, খুতবা ৬৪] বিশেষত আখেরি যামানায় শয়তান সর্বশক্তি দিয়ে মুমিনদের ওপর কুমন্ত্রণা ও প্রতারণার তীর নিক্ষেপ করবে, যাতে তারা পাপ ও বিভ্রান্তির পথে চলে যায়।

পরিশেষ, রিওয়ায়াতগুলো আমাদের স্পষ্ট করে সতর্ক করছে যে আখেরি যামানার বড় একটি পরীক্ষা হবে পরিবারের ভাঙন। সন্তান ও পিতামাতার সম্পর্কের অবনতি, তালাক ও আত্মীয়তার ছিন্ন হওয়া, এবং পিতামাতার প্রতি অসম্মান—এসবই সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। অতএব, মুসলিম সমাজের দায়িত্ব হলো পরিবারকে সুরক্ষিত রাখা, পারিবারিক অধিকার রক্ষা করা এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সতর্ক থাকা।

 

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button