কুরআনের দৃষ্টিতে অঙ্গীকারভঙ্গকারীর প্রতি অবিশ্বাস
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: কুরআনের দৃষ্টিতে যারা অহংকারে অন্ধ, বিশ্বাসহীন এবং প্রতিশ্রুতি-অবজ্ঞাকারী—তারা সমাজের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু। কারণ যাদের “অঙ্গীকার” ও “চুক্তি” বলে কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই, তাদের কাছে কেউ নিরাপদ নয়; না বন্ধু, না শত্রু। তাই এমন অঙ্গীকারভঙ্গকারীদের ওপর ভরসা করাকে কুরআন অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ বলে সতর্ক করে।
কুরআন অত্যাচারী ও ঈমানহীন অহংকারীদের এমন শত্রু হিসেবে উল্লেখ করে, যারা কখনোই অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি বা কোনো চুক্তিকে মূল্য দেয় না। তাদের স্বভাবই হলো প্রতারণা; তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেই। কারণ “לَا أَيْمَانَ لَهُمْ”—যাদের কোনো প্রতিশ্রুতি-বোধ নেই, তাদের ধোঁকা থেকে কেউই রক্ষা পায় না। এমন ব্যক্তিদের ওপর ভরসা করা নিছক মূর্খতা।
কুরআন একটি জীবন্ত ও চলমান গ্রন্থ—সময়ের পরম্পরা অতিক্রম করে যার উজ্জ্বল সত্য মানবের বিবেক ও জাগ্রত ফিতরাতকে আকৃষ্ট করে এসেছে। তার সত্য প্রতিশ্রুতি হচ্ছে—কর্মশীল মুমিনদের সফলতা এবং একগুঁয়ে অবিশ্বাসীদের ক্ষতি। কুরআন সত্য ও মিথ্যার মাঝে এমন এক আলোকিত ফয়সালা, যা মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নির্দেশ দেয়; কেননা মিথ্যার বিস্তার হলে যৌথ জীবন স্থায়ী হতে পারে না।
অহংকারীরা শুধু ঈমানহীনই নয়, অঙ্গীকার-বোধ থেকেও শূন্য। যে ব্যক্তি শপথ, চুক্তি বা সমঝোতাকে মূল্য দেয় না, তার সঙ্গে কোনো সমাজ কখনো স্থায়ী হতে পারে না। এ কারণেই কুরআন বলে—ঈমানের অভাব নয়, বরং অঙ্গীকারহীনতার কারণে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আবশ্যক:
“فَقَاتِلُوا أَئِمَّةَ الْكُفْرِ إِنَّهُمْ لَا أَيْمَانَ لَهُمْ لَعَلَّهُمْ يَنتَهُونَ”
ইতিহাস সাক্ষী—অত্যাচারীরা সব যুগে নিজেদের ‘উদ্ধারকর্তা’ হিসেবে সাজিয়ে, মানুষকে দুর্বল করে ব্যবহার করেছে:
“فَاسْتَخَفَّ قَوْمَهُ فَأَطَاعُوهُ”
কিন্তু ক্ষমতা হাতে পেয়েই তারা পৃথিবীকে নষ্ট করেছে, জাতিকে ধ্বংস করেছে:
“وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ…”
তারা শুধু শত্রুর ক্ষতিতে থেমে থাকেনি; নিজেদের স্বার্থে বন্ধুদেরও বিসর্জন দিয়েছে:
“وَلَا تَزَالُ تَطَّلِعُ عَلَى خَائِنَةٍ مِنْهُمْ”
অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকতাই তাদের স্বভাব, এবং তাদের মধ্যে কোনো হৃদয়-ঐক্য নেই:
“تَحْسَبُهُمْ جَمِيعًا وَقُلُوبُهُمْ شَتَّى”
ইতিহাসে দেখা যায়—সুযোগ পেলেই তারা নিজেদের লাভের জন্য বন্ধুদেরও বলি দিয়েছে। প্রতিশ্রুতির মুহূর্তেও ধোঁকা দিয়েছে, শুধু ক্ষমতার ফল পেতে।
এর বিপরীতে, আলীর (আ.) নূরানী মক্তবে অঙ্গীকার এমন মর্যাদা পায় যে, একজন নেতা নিজের চোখে অপেক্ষার আলো জ্বালিয়ে রাখেন—কখন প্রতিপক্ষ তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে। ওই ‘বলন্ত কুরআন’ ঘোষণা করে—একজন মুক্ত মানুষ প্রতিশ্রুতি দিলে ততক্ষণ পর্যন্ত যেন এক প্রকার দায়িত্ব-বন্দিত্বে থাকে, যতক্ষণ না সে তা পালন করে।
একদিকে আছে প্রতারণার ফসল; অন্যদিকে ন্যায়বিচার ও বিশ্বস্ততার ফসল—যা যুগে যুগে উত্তরাধিকার হয়ে প্রবাহিত হয়। ধার্মিক ও প্রাজ্ঞ মানুষ ইমামদের আধ্যাত্মিক সন্তান; আর অবাধ্য অজ্ঞরা হলো কুফর ও তাগুতের উত্তরসূরি।
কুরআন শেখায়—আল্লাহ তাঁর দীনকে রক্ষা করেন বন্ধুদের মাধ্যমে। তবে দীন রক্ষার এই সৌভাগ্য সবার নয়; বরং তাদের, যাদের প্রতি আল্লাহ ভালোবাসা বর্ষণ করেন এবং যারা আল্লাহকে ভালোবাসে:
“يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ”
যাদের বৈশিষ্ট্য—মুমিনদের প্রতি নম্রতা ও সত্যের শত্রুদের প্রতি অটল দৃঢ়তা:
“أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ”
ধর্মের আলেমরা, যারা ওহী ও ইতরাতের আলোয় জাতির প্রাজ্ঞ নেতা হয়েছেন, তাদের দায়িত্ব হলো নিরন্তর প্রতিরোধ—সেই দম্ভী অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে, যাদের নেই ঈমানের আলো, নেই অঙ্গীকার-রক্ষার নৈতিকতা।
সমসাময়িক প্রজ্ঞাবান নেতার ভাষ্যও এই সত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়:
যে রাষ্ট্র নিজের বন্ধুদের প্রতিও বিশ্বাসঘাতকতা করে, দস্যুবাহিনীর পাশে দাঁড়ায়, স্বার্থের জন্য বিশ্বের যেকোনো স্থানে যুদ্ধ বাধাতে দ্বিধা করে না—তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রত্যাশা করা যুক্তিহীন।
এটাই কুরআনের শিক্ষা—যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি বোঝে না, তার সঙ্গে কোনো যৌথ জীবন গড়ে ওঠে না। যেমন ন্যায় ও সত্যের মানুষরা প্রতারকদের সঙ্গে সমঝোতা করেননি, তেমনি সত্যের অনুসারীরাও তাদের উত্তরসূরিদের সঙ্গে আপস করতে পারে না।
অতএব বুদ্ধি ও ওহির নির্দেশ এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়—যে প্রতিশ্রুতি-অবজ্ঞা করে এবং অঙ্গীকারের প্রতি কোনো দায়বোধ রাখে না, তার ওপর ভরসা করা নির্বুদ্ধিতা। এমন ভুলের পরিণতিতে লজ্জা ও পরাজয় ছাড়া আর কিছু থাকে না—কারণ বুদ্ধি ও ওহী দু’টিই মানুষের আগে থেকেই সতর্ক করেছে।
আশা, আলোর পথপ্রদর্শনে আমরা এমন অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করব যাতে বুঝতে পারি—শত্রুর হাতে অস্ত্র না থাকলেও, তার হাতে প্রতারণা থাকে। (আলী গুলেস্তানী )
সূত্রসমূহ
১. তওবা : ১২ দ্রষ্টব্য: ইমামুল কুফ্র” বলতে সাধারণ অবিশ্বাসী নয়; বরং অবিশ্বাসের আদর্শ-প্রণেতা, চিন্তাবিদ এবং পথনির্দেশক—অর্থাৎ কুফরের মেরুদণ্ডস্বরূপ নেতাকে বোঝানো হয়েছে। তাই কুরআন প্রতিটি অমুসলিম অঙ্গীকারভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের নির্দেশ দেয় না। এখানে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও বিশ্বব্যাপী সামাজিক এক সত্য ঘোষণা করা হয়েছে—মানুষের সাধারণ অঙ্গীকারভঙ্গ নয়, বরং কুফরের নেতা-চরিত্রই সমাজকে বিপথে ঠেলে দেয়। এই নেতারাই মানুষের ইসলাম গ্রহণে সবচেয়ে বড় বাধা; তাই তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধের নির্দেশ এসেছে।)বিস্তারিত জানতে দেখুন: “মানবের বিপথগামিতা ও অপূর্ণতার ক্ষেত্রে তাগুতব্যবস্থার প্রভাব”—লেখক।
২. যুখরুফ : ৫৪ (ফিরাউনের কৌশল—মানুষকে হেয় করে তাদের আনুগত্য আদায় করেছিল।)
৩. বাকারা : ২০৫ (যখন তারা ক্ষমতা পায়, তখন পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করে ফসল ও মানবসম্ভার ধ্বংস করে; আর আল্লাহ অনর্থকে ভালবাসেন না।)
৪. মায়েদা : ১৩(তাদের কাছ থেকে বারবার বিশ্বাসঘাতকতা প্রকাশ পেতে থাকে।)
৫. হাশর : ১৪(তাদের বাহ্যিক ঐক্য দেখে এক মনে হয়, কিন্তু হৃদয়ে তারা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন।)
৬. জঙ্গ-এ-জামাল: উত্স, প্রতিক্রিয়া ও সংশয়, খণ্ড ১, পৃ. ২১৭ (উসমান ও মু’আবিয়া সংক্রান্ত ঐতিহাসিক ঘটনা উদ্ধৃত।)
৭. তারীখ-ই ইয়াকুবি, খণ্ড ২, পৃ. ১৭৫ (ওই ঘটনার আরেক দলিল; প্রতারণা ও সুযোগসন্ধানীতার বিবরণ।)
৮. পেয়াম-ই ইমাম আমীরুল মুমিনীন (আ.), হিকমত ৩৩৬-এর টীকা (ইমামের শিক্ষায় অঙ্গীকারের মর্যাদা।)
৯. নাহজুল বালাগা, হিকমত ৩৩৬ (“মানুষ প্রতিশ্রুতি না দেওয়া পর্যন্ত স্বাধীন; প্রতিশ্রুতি দিলে সে তার দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে”—এ বাণীর উৎস।)
১০. একই গ্রন্থ, খুৎবা ১২ (নেককারদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মে গভীর প্রভাব ও অবদানের উল্লেখ।)
১১. ওসাইলুশ শিয়া, খণ্ড ১৪, পৃ. ৫০৯ (“আমি ও আলী—এই উম্মতের দুই জনক”—এ বর্ণনার উৎস।)
১২. মায়েদা : ৫৪ (মুমিনদের প্রতি নম্রতা এবং সত্যের শত্রুদের প্রতি দৃঢ়তার বৈশিষ্ট্য।)
১৩. ইরানের সর্বোচ্চ নেতার টেলিভিশন ভাষণ—তারিখ: ০৬/০৯/১৪০৪
(ভাষণের মূল বক্তব্য: যারা নিজেদের বন্ধুদের প্রতিও বিশ্বাসঘাতকতা করে, দস্যুবাহিনী ও যুদ্ধবাজ শক্তির পাশে দাঁড়ায় এবং স্বার্থের জন্য পৃথিবীর যেকোনো স্থানে যুদ্ধ জ্বালাতে প্রস্তুত—তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করা কোনো সম্মানিত রাষ্ট্রের পক্ষে অনুচিত।)



