কুরআনের আয়াত অনুযায়ী কি আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান হেদায়াত দান করেন?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা হেদায়েত (সৎপথ) ও গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা) সম্পর্কে এমনভাবে আলোচনা করেছেন, যা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তিনি হেদায়েত দান করেন তাদেরকে, যারা সত্যের পথে অগ্রসর হয়, আর পথভ্রষ্ট করেন তাদেরকে, যারা নিজেই অন্যায়, অহংকার ও অবাধ্যতার পথ বেছে নেয়।
কুরআনের আয়াতসমূহ
سورة النحل، آية 93 وَلَوْ شَاءَ ٱللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةًۭ وَٰحِدَةًۭ وَلَـٰكِن يُضِلُّ مَن يَشَآءُ وَيَهْدِى مَن يَشَآءُ ۚ وَلَتُسْـَٔلُنَّ عَمَّا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
১. আল্লাহ চাইলে তোমাদের সবাইকে এক জাতি বানিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেন। তোমরা অবশ্যই তোমাদের কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
سورة الكهف، آية 17 مَن يَهْدِ ٱللَّهُ فَهُوَ ٱلْمُهْتَدِ ۖ وَمَن يُضْلِلْ فَلَن تَجِدَ لَهُۥ وَلِيًّۭا مُّرْشِدًۭا
২. যাকে আল্লাহ হেদায়েত দেন, সে-ই সঠিক পথে আছে। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য তুমি কোনো সাহায্যকারী বা পথপ্রদর্শক পাবে না।
سورة الأعراف، آية 186 مَن يُضْلِلِ ٱللَّهُ فَلَا هَادِىَ لَهُۥ ۚ وَيَذَرُهُمْ فِى طُغْيَـٰنِهِمْ يَعْمَهُونَ
৩.আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই। তিনি তাদেরকে তাদের গোমরাহির মধ্যে ছেড়ে দেন, যাতে তারা বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
سورة الزمر، آية 36–37 فَمَن يُضْلِلِ ٱللَّهُ فَمَا لَهُۥ مِنْ هَادٍۢ ﴿٣٦﴾ وَمَن يَهْدِ ٱللَّهُ فَمَا لَهُۥ مِن مُّضِلٍّۢ ۗ أَلَيْسَ ٱللَّهُ بِعَزِيزٍۢ ذِى ٱنتِقَامٍۢ
৪. আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই। আর যাকে তিনি হেদায়েত দেন, তার কোনো পথভ্রষ্টকারী নেই। আল্লাহ তো পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।
হেদায়েত ও গোমরাহির প্রকৃত ব্যাখ্যা
অনেক মুফাসসির বলেন, এই আয়াতগুলোকে এককভাবে নয়, বরং সমগ্র কুরআনের আলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে। আল্লাহর হেদায়েত ও গোমরাহী প্রাথমিক নয়, বরং মানুষের কর্মের প্রতিফল। অর্থাৎ, কেউ যদি নিজেই অন্যায়, পাপ ও অহংকারের পথে চলে এবং তাওবা না করে, তবে আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেন। আর যে ব্যক্তি সত্যের সন্ধান করে, তাওবা করে, আল্লাহ তাকে হেদায়েত দেন।
মানুষের স্বাধীনতা ও হেদায়েতের শর্ত: কুরআনের আলোকে
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
يُضِلُّ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي مَن يَشَاءُ “তিনি যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেন।” (সূরা নাহল, আয়াত ৯৩)
এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, হেদায়েত ও গোমরাহি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। কিন্তু কুরআনের অন্যান্য আয়াতগুলো ব্যাখ্যা করে দেয়—এই ইচ্ছা মানুষের কর্ম ও মনোভাবের প্রতিফলন।
গোমরাহির কারণ ও আল্লাহর ন্যায়বিচার
আল্লাহ বলেন:
وَيُضِلُّ اللَّهُ الظَّالِمِينَ “আল্লাহ জালিমদের পথভ্রষ্ট করেন।” (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ২৭)
كَذَٰلِكَ يُضِلُّ اللَّهُ مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ مُّرْتَابٌ “আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেন, যে অপচয়কারী ও সন্দেহপ্রবণ।” (সূরা গাফির, আয়াত ৩৪)
كَذَٰلِكَ يُضِلُّ اللَّهُ الْكَافِرِينَ “আল্লাহ কাফিরদের পথভ্রষ্ট করেন।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৬)
এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে—আল্লাহ সেইসব মানুষকে পথভ্রষ্ট করেন, যারা নিজেই অন্যায়, কুফর, অপচয় ও অবাধ্যতার পথ বেছে নেয়। অর্থাৎ, গোমরাহির সূচনা হয় মানুষের পক্ষ থেকে।
হেদায়েতের শর্ত ও আল্লাহর প্রতিশ্রুতি
আল্লাহ বলেন:
يَهْدِي مَن يَشَاءُ “তিনি যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেন।”
কিন্তু এর শর্তও রয়েছে:
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا “যারা আমাদের পথে চেষ্টা করে, আমরা অবশ্যই তাদেরকে আমাদের পথ দেখাব।” (সূরা আনকাবুত, আয়াত ৬৯)
আরও আয়াতে বলা হয়েছে:
إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ “আল্লাহ ফাসিকদের হেদায়েত দেন না।” (সূরা আল-মুনাফিকুন, আয়াত ৬)
إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ “আল্লাহ কাফিরদের হেদায়েত দেন না।” (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত ৭২)
إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي كَيْدَ الْخَائِنِينَ “আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রকে হেদায়েত দেন না।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৫২)
إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ “আল্লাহ মিথ্যাবাদী ও অকৃতজ্ঞকে হেদায়েত দেন না।” (সূরা আল-যুমার, আয়াত ৩)
হেদায়েতের পথে মানুষের দায়িত্ব ও স্বাধীনতা
আল্লাহ তাআলা পথ দেখান, কিন্তু সেই পথে চলার দায়িত্ব মানুষের নিজের। সৃষ্টিকর্তা পথের দিশা দেন, আর সৃষ্টি সেই পথ গ্রহণ করে কিনা—এটাই তার দায়িত্ব। যদি কেউ নিজেই সঠিক পথ ছেড়ে দিয়ে বিপথে চলে যায়, তবে তার দায় একান্তই তার নিজের।
আল্লাহ কুরআনে বলেন:
وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَىٰ دَارِ السَّلَامِ “আল্লাহ শান্তির ঘরে (জান্নাতে) আহ্বান জানান।” (সূরা ইউনুস, আয়াত ২৫)
তিনি আরও বলেন:
مَن شَاءَ ٱتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِۦ سَبِيلًا “যে ইচ্ছা করে, সে তার প্রভুর দিকে যাওয়ার পথ গ্রহণ করে।” (সূরা আল-ইনসান, আয়াত ২৯)
আর যারা আল্লাহর পথে চেষ্টা করে, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ:
وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَا “যারা আমাদের পথে চেষ্টা করে, আমরা অবশ্যই তাদেরকে আমাদের পথ দেখাব।” (সূরা আনকাবুত, আয়াত ৬৯)
কিন্তু যারা আল্লাহর দিকে আগ্রহী নয়, যারা তাঁর আয়াত, রাসূল ও পরকালকে অস্বীকার করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন পরিণতি:
إِنَّ ٱلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِـَٔايَـٰتِ ٱللَّهِ لَا يَهْدِيهِمُ ٱللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ “যারা আল্লাহর আয়াতে বিশ্বাস করে না, আল্লাহ তাদের হেদায়েত করেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।” (সূরা নাহল, আয়াত ১০৪)
স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত: মানুষের হাতে
এই আয়াতগুলো স্পষ্ট করে দেয়—আল্লাহ প্রত্যেককে স্বাধীনতা দিয়েছেন। তিনি বলেন:
إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا “আমরা মানুষকে পথ দেখিয়েছি—সে চাইলে কৃতজ্ঞ হতে পারে, চাইলে অকৃতজ্ঞ।” (সূরা আল-ইনসান, আয়াত ৩)
অর্থাৎ, মানুষের সামনে সত্য ও মিথ্যার পথ উন্মুক্ত। সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় কোন পথে চলবে।
হেদায়েতের যোগ্যতা ও গোমরাহির পরিণতি
আল্লাহ কখনো জালিম, পাপী, মিথ্যাবাদী বা অবাধ্যদের হেদায়েত করেন না। যেমন বলা হয়েছে:
وَمَن يَعْصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَٰلًۭا مُّبِينًا “যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করে, সে স্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট।” (সূরা আহযাব, আয়াত ৩৬)
আর যারা সত্যের পথে চলে, তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য আল্লাহ হেদায়েতের দরজা খুলে দেন:
إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِى ٱلْقَوْمَ ٱلظَّـٰلِمِينَ “আল্লাহ জালিম জাতিকে হেদায়েত দেন না।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৫৮)
يَا أَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُوا۟ إِن تَتَّقُوا۟ ٱللَّهَ يَجْعَل لَّكُمْ فُرْقَانًا “হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তিনি তোমাদের জন্য সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী শক্তি দান করবেন।” (সূরা আল-আনফাল, আয়াত ২৯)
সত্য ও মিথ্যার পথ উন্মুক্ত। আল্লাহ পথ দেখান, কিন্তু সেই পথে চলা মানুষের নিজের সিদ্ধান্ত। যে ব্যক্তি সত্যকে গ্রহণ করে, তাকওয়া অবলম্বন করে, সে হেদায়েতের যোগ্য। আর যে ব্যক্তি অহংকার, জুলুম ও অবাধ্যতার পথ বেছে নেয়, সে নিজেই গোমরাহির দিকে এগিয়ে যায়।
এই সত্য প্রতিটি মানুষের অন্তরেই প্রতিধ্বনিত হয়—ভালো বা মন্দ পথের নির্বাচন, শুরু থেকেই আমাদের হাতে।
পাদটীকা
১.আল্লাহ চাইলে তোমাদের সবাইকে এক জাতি বানিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেন। তোমরা অবশ্যই তোমাদের কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (সূরা নাহল, আয়াত ৯৩)
২.যাকে আল্লাহ হেদায়েত দেন, সে-ই প্রকৃতভাবে সৎপথে আছে। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য তুমি কোনো সাহায্যকারী বা পথপ্রদর্শক পাবে না।” (সূরা কাহফ, আয়াত ১৭)
৩.আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই। তিনি তাদেরকে তাদের গোমরাহির মধ্যে ছেড়ে দেন, যাতে তারা বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়।” (সূরা আ‘রাফ, আয়াত ১৮৬)
৪.আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই। আর যাকে তিনি হেদায়েত দেন, তার কোনো পথভ্রষ্টকারী নেই।” (সূরা যুমার, আয়াত ৩৬–৩৭)
৫. আল্লামা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ হোসেইন তাবাতাবায়ী, আল-মিজান ফি তাফসির আল-কুরআন, খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ৩৩৬, কুম, ইসলামিক পাবলিকেশন অফিস, পঞ্চম সংস্করণ, ১৪১৭ হিজরি। অনুবাদ: সাইয়্যেদ মোহাম্মদ বাকের মুসাভি হামাদানি, আল-মিজান অনুবাদ, খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ৪৮৫, কোম, ইসলামিক পাবলিকেশন অফিস, পঞ্চম সংস্করণ, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ।



