কীভাবে পূর্ণ হবে মানবাধিকারের ক্ষত-বিক্ষত প্রান্তর?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ইসলামে হাক্কুন নাস বা মানুষের অধিকার লঙ্ঘন অত্যন্ত গুরুতর বিষয়। শুধু মুখে “استغفار” বলা বা ক্ষমা প্রার্থনা করলেই এ দায় থেকে মুক্তি মেলে না; বরং প্রকৃত অনুতাপ, যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং প্রয়োজনে সৎকর্মই মানুষের ওপর থাকা এই ভারকে লাঘব করতে পারে।
হাক্কুন নাস—শুধু ইস্তেগফার (استغفار) যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন আন্তরিক অনুতাপ, উপযুক্ত প্রতিকারমূলক সৎকর্ম, এবং সরাসরি ক্ষতিপূরণ সম্ভব না হলে আল্লাহর ওপর ভরসা করে দায়িত্ব হালকা করা, যাতে মানুষ ধর্মীয়ভাবে এই দায় থেকে মুক্ত হতে পারে।
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মোহাম্মাদি শাহরূদি “মানুষের কাছে হালাল নেওয়ার আদব” শিরোনামের এক প্রশ্নোত্তরে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
প্রশ্ন: কারও হক্ বা অধিকার যদি আমার কারণে নষ্ট হয়ে থাকে, কিন্তু বর্তমানে তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নয় এবং ‘রাদ্দে মাজালেম’ও করা যাচ্ছে না—তাহলে কি জীবিত ব্যক্তির জন্য ইস্তেগফার করা হলে সেই হাক্কুর নাসের বোঝা হালকা হবে?
উত্তর: প্রথমে নির্ধারণ করতে হবে হাক্কুর নাস কোন ধরনের, কারণ মানুষের অধিকার লঙ্ঘন বিভিন্ন রূপে ঘটে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রের সমাধান আলাদা। সাধারণভাবে চার প্রকার হক্নাস উল্লেখ করা যায়:
প্রথম ধরন
১. আর্থিক হাক্কুর নাস: যে অর্থ বা সম্পদ অন্যের, তা যেভাবে হোক মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া আবশ্যক। সুযোগ পাওয়া মাত্র তা পরিশোধ করতে হবে।
২. জীবন বা শারীরিক ক্ষতির হাক্কুর নাস: এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ, দিয়া, কিসাস অথবা সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করতে হয়।
৩. জমি-সম্পত্তি সংক্রান্ত হাক্কুর নাস: এই ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
৪. গোমরাহ বা বিভ্রান্ত করা, মানসিক বা আধ্যাত্মিক ক্ষতি: এর ক্ষতিপূরণও বিশেষ পদ্ধতিতে করতে হয়; একক কোনো সমাধানে সব ক্ষেত্রে কাজ হয় না।
অতএব, হাক্কুর নাস একমাত্র ইস্তেগফার দ্বারা দূর হয় না।
দ্বিতীয় ধরন
যদি কারও পক্ষে সরাসরি ক্ষতিপূরণ দেওয়া বা অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া অসম্ভব হয়, তবে তাকে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে—
ক. হাক্কুর নাসের পরিমাণ ও গুরুত্ব বিবেচনা করে সৎকর্ম সম্পাদন করা, যাতে কিয়ামতের দিনে সেই সাওয়াব ক্ষতিপূরণ হিসেবে গণ্য হয়।
খ. সৎকর্মের পরিমাণ যেন ক্ষতির মাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। শুধু কয়েক সেকেন্ডের “استغفرالله” বলা বা সামান্য কাজ করার মাধ্যমে বিশাল ক্ষতি পূরণ হয় না। উদাহরণস্বরূপ, কারও কোটি টাকার ক্ষতি করে দিলে কয়েকটি ছোটখাটো কাজ যথেষ্ট নয়; উপযুক্ত মাত্রায় সৎকর্ম করতে হবে।
তৃতীয় ধরন
যদি কারও আর্থিক সামর্থ্য থাকে, তবে সরাসরি অর্থ ফেরত দেওয়া উত্তম। পাশাপাশি সমপরিমাণ সৎকর্ম করলেও তা হাক্বুর নাস লাঘবে সহায়ক হতে পারে। যদি অধিকারভোগীকে খুঁজে পাওয়া না যায় বা তিনি দান গ্রহণে সম্মত না হন—
ক. তাকে পাওয়া না গেলে তার উদ্দেশে সৎকর্ম ও সদকা গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
খ. কিন্তু তাকে পাওয়া গেলে এবং তিনি সরাসরি পাওনা ফেরত ছাড়া কিছু মানতে না চাইলে কেবল সৎকর্ম যথেষ্ট নয়; অবশ্যই তার অধিকার পরিশোধ করতে হবে।
চতুর্থ ধরন
বিশেষ পরিস্থিতিতে, যখন ব্যক্তি একেবারেই অক্ষম—না আর্থিকভাবে, না যোগাযোগের মাধ্যমে—কিন্তু তার ঈমান ও সৎকর্ম আছে—
ক. আল্লাহ নিজেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে তার জন্য সন্তুষ্টি আদায় করবেন।
খ. এমন অবস্থায় তার সৎকর্ম হক্নাস লাঘবে ভূমিকা রাখতে পারে, যদিও সরাসরি পরিশোধ সম্ভব নয়।
সারসংক্ষেপ
শুধু ইস্তেগফার হাক্কুর নাস থেকে মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। বরং—
১- প্রকৃত ও গভীর অনুতাপ,
২- অধিকারের পরিমাণ অনুযায়ী সৎকর্ম,
৩- সম্ভব হলে সরাসরি ক্ষতিপূরণ, আর
৪-. সম্পূর্ণ অক্ষম হলে আল্লাহর ওপর ভরসা,
—এসবের সমন্বয়ে মানুষের ওপর থাকা হক্নাসের বোঝা হালকা হতে পারে এবং ব্যক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে মুক্তির আশা করতে পারে।



