ঋণভারাক্রান্ত মানুষের প্রতি করুণাবশত দেনা পরিশোধের অবকাশ প্রদানের পুণ্যফল ও তাৎপর্য বিষয়ক বিশ্লেষণ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: মানবজীবনে ঋণ একটি বাস্তব ও অনিবার্য বিষয়। কখনো প্রয়োজনের তাগিদে, কখনো বিপদের চাপে মানুষ ঋণের আশ্রয় নেয়। ইসলাম ঋণগ্রহণ ও ঋণপ্রদানের বিষয়টিকে বাস্তবতার নিরিখে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং একই সঙ্গে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা—উভয়ের জন্য নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। কুরআন ও আহলে বাইত (আ.)-এর বাণীতে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে সেই পরিস্থিতি, যখন ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তাকে সময় দেওয়া কেবল মানবিক সহানুভূতির প্রকাশ নয়; বরং এটি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত, যার জন্য মহান আল্লাহ বিশেষ ও বহুগুণ সওয়াব নির্ধারণ করেছেন।
এই প্রবন্ধে কুরআনের আয়াত ও নির্ভরযোগ্য হাদিসের আলোকে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে সময় দেওয়ার সওয়াব, প্রভাব ও পারলৌকিক মর্যাদা বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।
প্রশ্ন:যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে অপারগ, তাকে সময় প্রদান করলে কী ধরনের পারলৌকিক পুরস্কার লাভ হয়? এটি কি কেবল ঋণদানের সওয়াবের অন্তর্ভুক্ত, নাকি এর জন্য আলাদা মর্যাদা রয়েছে?
উত্তর: আহলে বাইত (আ.)-এর শিক্ষা অনুযায়ী, ঋণদান যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি দেনাদারের দুরবস্থা অনুধাবন করে তাকে সময় দেওয়া আরও উচ্চতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার অধিকারী। হাদিসসমূহ প্রমাণ করে, এই সহনশীলতা একটি স্বতন্ত্র সৎকর্ম, যার প্রতিদান বহুমাত্রিক।
১. কুরআনের দৃষ্টিতে ঋণগ্রস্তকে সময় দেওয়া
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতি সহনশীলতা ও উদারতার বিষয়ে কুরআন মাজিদ অত্যন্ত স্পষ্ট ও হৃদয়স্পর্শী নির্দেশনা প্রদান করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَإِنْ كَانَ ذُو عُسْرَةٍ فَنَظِرَةٌ إِلَىٰ مَيْسَرَةٍ ۚ وَأَنْ تَصَدَّقُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৮০)
আর যদি দেনাদার কষ্টে থাকে, তবে তাকে স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দাও; আর যদি তোমরা ক্ষমা করে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম—যদি তোমরা জানতে।”
এই আয়াতে আল্লাহ প্রথমে বাধ্যতামূলক নৈতিক নির্দেশ দিয়েছেন—অক্ষম দেনাদারকে সময় দিতে হবে। এরপর আরও উচ্চতর মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন—ক্ষমা করে দেওয়া, যা সময় দেওয়ার চেয়েও উত্তম। এটি প্রমাণ করে যে, ঋণগ্রস্তের প্রতি সহানুভূতি ইসলামে কেবল সামাজিক সৌজন্য নয়, বরং একটি আল্লাহপ্রদত্ত আদর্শ।
২. সময় দেওয়া মানেই প্রতিদিন সদকার সওয়াব
হাদিসে ঋণগ্রস্তকে সময় দেওয়ার সওয়াবকে সদকার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন—নবী (সা.) একদিন মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেন:
“যে ব্যক্তি অক্ষম দেনাদারকে সময় দেয়, সে যতদিন সময় দেয়, ততদিন প্রতিদিন আল্লাহ তার জন্য তার পাওনার সমপরিমাণ সদকার সওয়াব লিখে দেন—যতক্ষণ না সে তার ঋণ আদায় করে।”
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, সময় দেওয়া কোনো স্থির সওয়াব নয়; বরং এটি একটি ধারাবাহিক ইবাদত, যার সওয়াব প্রতিদিন নবায়িত হয়। যেন ঋণদাতা প্রতিদিন নতুন করে দান করছেন।
৩. জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়
ঋণগ্রস্তের প্রতি দয়া কেবল সওয়াব বৃদ্ধির মাধ্যমই নয়, বরং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির কারণও। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক উত্তপ্ত দিনে বলেন:
“যে ব্যক্তি জাহান্নামের তাপ থেকে রক্ষা পেতে চায়, সে যেন অক্ষম দেনাদারকে সময় দেয় অথবা তার পাওনা মাফ করে দেয়।”
এই হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—দেনাদারের প্রতি সহজ আচরণ আখিরাতে আগুনের আযাব থেকে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
৪. কিয়ামতের দিনের ছায়া
কিয়ামতের দিন হবে এমন এক ভয়াবহ দিন, যেদিন সূর্য মানুষের মাথার খুব কাছে থাকবে এবং আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোনো আশ্রয় থাকবে না। সেই কঠিন দিনে কারা আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয় পাবে—সে বিষয়ে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন:
“যে ব্যক্তি চায় আল্লাহ তাকে সেই দিনে ছায়া দিন—যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া নেই—সে যেন অক্ষম দেনাদারকে সময় দেয় অথবা তার পাওনার কিছু ছেড়ে দেয়।”
এতে বোঝা যায়, দুনিয়ায় করা সামান্য সহনশীলতা আখিরাতে মহাসুরক্ষার কারণ হয়ে ওঠে।
৫. যাকাতের সওয়াব ও ফেরেশতাদের দোয়া
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ঋণ দেয় এবং তার স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তার সম্পদ যাকাত হিসেবে গণ্য হয় এবং ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকেন—যতক্ষণ না ঋণ পরিশোধ করা হয়।”
যাকাতের যে বহুবিধ কল্যাণ—রিজিক বৃদ্ধি, গুনাহ মোচন, সম্পদের নিরাপত্তা—সবই এই সময়দানকারীর জন্য প্রযোজ্য হয়ে যায়।
৬. আল্লাহর বিশেষ ক্ষমা
এক হৃদয়স্পর্শী হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—পূর্ববর্তী উম্মতদের এক ব্যক্তির আমলনামায় বড় কোনো ইবাদত পাওয়া যায়নি; শুধু এই একটি গুণ ছিল যে, সে তার কর্মচারীদের নির্দেশ দিত যেন তারা দরিদ্র দেনাদারদের প্রতি কঠোর না হয়। আল্লাহ তখন বলেন:আমি তার চেয়েও ক্ষমাশীল—তাকে ক্ষমা করে দাও।
এ থেকে স্পষ্ট হয়, দেনাদারের প্রতি সহনশীলতা আল্লাহর ক্ষমা অর্জনের শক্তিশালী মাধ্যম।
৭. কিয়ামতে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান
ইমাম মুহাম্মদ বাকির (আ.) এক অনন্য বর্ণনায় বলেন—কিয়ামতের দিন কিছু মানুষ আরশের ছায়ায় থাকবে, নূরের আসনে বসবে, নূরের পোশাক পরিধান করবে। লোকেরা মনে করবে তারা নবী বা শহীদ; কিন্তু ঘোষণা আসবে:
“এরা নবীও নয়, শহীদও নয়; বরং এরা সেই মানুষ, যারা মুমিনদের প্রতি সহজ আচরণ করত এবং অক্ষম দেনাদারকে সময় দিত।”
এটি প্রমাণ করে যে, এই আমল মানুষকে কিয়ামতের বিশেষ ও বিরল মর্যাদায় পৌঁছে দেয়।
উপসংহার
কুরআন ও হাদিসের আলোকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে সময় দেওয়া কেবল ঋণদানের সওয়াবের অংশ নয়; বরং এটি একটি স্বতন্ত্র, পূর্ণাঙ্গ ও বহুমাত্রিক ইবাদত। এই আমলের মাধ্যমে বান্দা সদকার ধারাবাহিক সওয়াব অর্জন করে, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায়, কিয়ামতের ছায়া লাভ করে, ফেরেশতাদের দোয়া ও আল্লাহর ক্ষমার অধিকারী হয় এবং পরকালে এক বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়।
অতএব, দেনাদারের প্রতি সহনশীলতা কেবল সামাজিক নৈতিকতা নয়; বরং এটি এমন এক আমল, যা দুনিয়া ও আখিরাত—উভয় জগতেই কল্যাণের দুয়ার খুলে দেয়।
পাদটীকা:
১. মুহাম্মদ ইবন ইয়াকুব কুলাইনি প্রণীত আল-কাফি গ্রন্থ; সম্পাদনা ও পরিশোধন করেছেন আলী-আকবর গাফফারি ও মুহাম্মদ আখুন্দি; তেহরান: দারুল কুতুব আল-ইসলামিয়া, ১৪০৭ হিজরি; চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫, হাদিস নম্বর ৪।
২. মুহাম্মদ ইবন মাসউদ আইয়াশির তাফসিরুল আইয়াশি; সম্পাদক সাইয়্যেদ হাশেম রাসুলি মাহাল্লাতি; তেহরান: আল-মাতবা‘আ আল-ইলমিয়া, ১৩৮০ হিজরি; প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৫, হাদিস ৫১০।
৩. ইমাম অষ্টম আলী ইবন মূসা আর-রিদা (আ.)-এর প্রতি সমর্পিত আল-ফিকহুল মানসুব ইলা আল-ইমাম আর-রিদা (আ.); মাশহাদ: মু’আসসাসাতু আলে বাইত (আ.), ১৪০৬ হিজরি; পৃষ্ঠা ২৫৭।
৪. কুলাইনি, আল-কাফি; চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫, হাদিস ২।
৫. আইয়াশি, তাফসিরুল আইয়াশি; প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৪।
৬. কুলাইনি, আল-কাফি; চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫, হাদিস ১।
৭. কুলাইনি, আল-কাফি; অষ্টম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯, হাদিস ১।
৮. শাইখ সাদুক (মুহাম্মদ ইবন আলী ইবন বাবাওয়াইহ), সওয়াবুল আ‘মাল ও ইকাবুল আ‘মাল; কোম: দারুশ শরিফ আর-রযি, ১৪০৬ হিজরি; পৃষ্ঠা ১৩৮।
৯. আবদুল্লাহ ইবন জাফর হুমাইরি, কুরবুল ইসনাদ; কোম: মু’আসসাসাতু আলে বাইত (আ.), ১৪১৩ হিজরি; পৃষ্ঠা ১১৭।
১০. আইয়াশি, তাফসিরুল আইয়াশি; প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯১।
১১. মুহাম্মদ ইবন হাসান তুসি, আল-আমালি; কোম: দারুস সাকাফাহ, ১৪১৪ হিজরি; পৃষ্ঠা ২৯৬।
১২. মাসউদ ইবন ঈসা ওয়াররাম ইবন আবি ফারাস রচিত মাজমু‘আয়ে ওয়াররাম; মাশহাদ: আস্তান কুদস রাযাভি ইসলামী গবেষণা ফাউন্ডেশন, ১৩৬৯ সৌর হিজরি; প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮।
১৩. শাইখ সাদুক, সওয়াবুল আ‘মাল ও ইকাবুল আ‘মাল; পৃষ্ঠা ১৪৫।
উৎস: জাতীয় ধর্মীয় প্রশ্নোত্তর কেন্দ্র।



