ধর্ম ও বিশ্বাসবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণহাদিস

ঈমানের আলো ও কৃতজ্ঞতার সিজদা

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৪ নভেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইমাম যায়নুল আবিদীন (আ.)ইবাদতের গভীরতম রূপের প্রতীক। তাঁর প্রতিটি সিজদা ছিল আত্মসমর্পণের নিদর্শন, প্রতিটি দোয়া ছিল বিনয় ও কৃতজ্ঞতার প্রতিধ্বনি। সেই সিজদার এক বাণীতে তিনি মানুষের আত্মজিজ্ঞাসার সর্বোচ্চ ভাষা উচ্চারণ করেছেন—যেখানে পাপীও আশ্রয় খোঁজে, কিন্তু আশ্রয় খোঁজার ভাষাটি হয়ে ওঠে প্রশান্তির কবিতা।

সিজদার প্রার্থনা: বিনয় ও কৃতজ্ঞতার সংলাপ

ইমাম যায়নুল আবিদীন (আ.) তাঁর এক সিজদায় এভাবে মুনাজাত করেছেন:

اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتُ قَدْ عَصَيْتُكَ، فَقَدْ أَطَعْتُكَ فِي أَحَبِّ الْأَشْيَاءِ إِلَيْكَ، وَهُوَ الْإِيمَانُ بِكَ، وَذٰلِكَ مِنْ فَضْلِكَ لَا مِنِّي؛
وَلَمْ أَعْصِكَ فِي أَبْغَضِ الْأَشْيَاءِ إِلَيْكَ، وَهُوَ الشِّرْكُ بِكَ، وَذٰلِكَ مِنْ فَضْلِكَ لَا مِنِّي.

হে আল্লাহ! যদি আমি তোমার অবাধ্য হয়ে থাকি, তবে আমি তোমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়ে তোমার আনুগত্য করেছি—তা হলো তোমার প্রতি ঈমান আনা। এ ঈমান তোমারই অনুগ্রহ, আমার কৃতিত্ব নয়। আর আমি তোমার সবচেয়ে ঘৃণিত বিষয়ে অবাধ্য হইনি—তা হলো তোমার জন্য কোনো সন্তান বা শরীক দাবি করা।
এটিও তোমারই অনুগ্রহ, আমার পক্ষ থেকে নয়।

অন্তরের আত্মসমর্পণ

ইমামের এই দোয়ায় প্রতিফলিত হয়েছে এক গভীর আত্মজ্ঞান। তিনি নিজের পাপ স্বীকার করছেন, তবে আত্মসমালোচনার মধ্যে নয়—বরং স্বীকার করছেন যে, তাঁর ঈমান ও তাওহিদ আসলে আল্লাহর করুণা, মানুষের অর্জন নয়।

এই বিনয়ই এক মুমিনের সর্বোচ্চ গৌরব—যেখানে আত্মসচেতনতা অহংকারে নয়, বরং কৃতজ্ঞতায় রূপ নেয়।

ঈমান: আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় অনুগ্রহ

ইমামের ভাষা আমাদের শেখায়— মানুষ যতই দুর্বল বা ত্রুটিপূর্ণ হোক, যদি তার হৃদয়ে ঈমানের আলো থাকে, তবে সে এখনো আল্লাহর রহমতের ছায়ায় আছে।

আল্লাহ বলেন:

إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيعَادَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। (সূরা রূম, আয়াত ৬)

ঈমান আল্লাহর প্রিয়তম উপহার, আর শিরক তাঁর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ।
যে মানুষ এই দুই সীমার মধ্যে নিজের অবস্থান বোঝে, সে প্রকৃত মুক্ত মানুষ।

কৃতজ্ঞতার সিজদা: এক মুমিনের পরিচয়

ইমাম যায়নুল আবিদীন (আ.) এর সিজদা কেবল ব্যক্তিগত প্রার্থনা নয়— এটি প্রত্যেক ঈমানদারের হৃদয়ের দোয়া। কারণ প্রকৃত মুমিন জানে: তার ঈমান, তার আনুগত্য, এমনকি তার তওবাও আল্লাহরই অনুগ্রহ। সেই উপলব্ধি মানুষকে অহংকার থেকে মুক্ত করে এবং তার আত্মাকে শান্তির বন্দরে পৌঁছে দেয়।

আতএব যে হৃদয় কৃতজ্ঞতার সিজদায় নত হয়ে বলে—

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ وَالْأَبْصَارِ، ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
হে হৃদয় ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী প্রভু! আমার হৃদয়কে তোমার দ্বীনের ওপর দৃঢ় রাখো। সে-ই হৃদয় আসলে ঈমানের আলোতে উজ্জ্বল,আর সেই আলোই হলো স্থায়ী প্রশান্তির রহস্য।

পাদটীকা

১.সহীফা সিজ্জাদিয়া, দোয়া নম্বর ৪৭; ইমাম যায়নুল আবিদীন (আঃ)-এর সিজদার মুনাজাত থেকে উদ্ধৃত।

২.আল-কুরআন, সূরা রূম, আয়াত ৬ — “আল্লাহ কখনো তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।

৩.সহীহ মুসলিম, কিতাবুল কদর, হাদীস ২৬৫৪ — নবী করিম (সা.)-এর দোয়া: হে হৃদয়ের পরিবর্তনকারী প্রভু, আমার হৃদয়কে তোমার দ্বীনের ওপর স্থির রাখো।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button