জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

ইসলামে কেন এমন বিধান রয়েছে যে কোনো মা যদি নিজের সন্তানকে হত্যা করেন, তবে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, অথচ একই অপরাধে পিতা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হন না? 

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলামী ফিকহে পিতা ও মাতার দ্বারা সন্তান হত্যার ক্ষেত্রে শাস্তির পার্থক্য নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি দেখা যায়। অনেকেই একে বৈষম্য বা বিরোধাভাস মনে করেন। তবে ফিকহি বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই পার্থক্য মানবিক মূল্যবোধের অসমতা থেকে নয়; বরং অপরাধের প্রকৃতি, সামাজিক প্রভাব এবং শরিয়তের দৃষ্টিতে শাস্তির ধরন ও উদ্দেশ্যের ভিন্নতার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এ বিষয়ে হুজা নিউজ এজেন্সিতে হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মোহাম্মদী শাহরুদীর একটি প্রশ্নোত্তরভিত্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে।

পিতা ও মাতার দ্বারা সন্তান হত্যার ক্ষেত্রে শাস্তির পার্থক্য:

ইসলামী ফিকহে বলা হয়, পিতা বা মাতা যদি নিজের সন্তানকে হত্যা করেন, তবে শাস্তির ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। পিতার ক্ষেত্রে কিসাস কার্যকর হয় না; তবে তিনি সাধারণ শাস্তির আওতায় পড়েন এবং সন্তান থেকে উত্তরাধিকার পাওয়ার অধিকার হারান। অন্যদিকে, মাতা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানকে হত্যা করেন, তবে তাঁর ক্ষেত্রে কিসাস প্রযোজ্য হয়। এই পার্থক্যের মূল কারণ হলো মানবিক মনস্তত্ত্ব, অপরাধের প্রকৃতি ও তার সামাজিক বিশ্লেষণ।

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মোহাম্মদী শাহরুদী এই বিষয়ে একটি প্রশ্নোত্তরে বলেন—

প্রশ্ন: ইসলামে বলা হয়, যদি পিতা নিজের সন্তানকে হত্যা করেন, তবে তাঁকে কিসাস দেওয়া হয় না; কিন্তু যদি মাতা এই অপরাধ করেন, তবে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়। এটি কি কোনো বিরোধাভাস নয়?

উত্তর: প্রথমেই স্পষ্ট করা প্রয়োজন—এ কথা বলা যে “পিতা সন্তান হত্যা করলে কোনো শাস্তি পান না” সম্পূর্ণ ভুল। পিতা অবশ্যই শাস্তির মুখোমুখি হন, তবে সেই শাস্তির ধরন ও ভিত্তি ভিন্ন।

ইসলামী ফিকহে আমরা একাধিক দিক বিবেচনা করি—
১. হক্কুন্‌নাস (ব্যক্তিগত অধিকার)
২. হক্কুল্লাহ (আল্লাহর অধিকার)
৩. অপরাধের সামগ্রিক বা জনস্বার্থমূলক দিক, যেখানে রাষ্ট্র বা সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ (মুদ্দাঈ আল-উমূমি) উপস্থিত থাকে।

জনস্বার্থের দিক থেকে

এই দৃষ্টিকোণ থেকে পিতা ও মাতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কোনো পিতা যখন নিজের সন্তানকে হত্যা করেন, তখন তিনি সমাজের সামষ্টিক অনুভূতিতে আঘাত হানেন এবং একটি গুরুতর অপরাধ সংঘটিত করেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং এমনকি কঠোর শাস্তি—প্রয়োজনে মৃত্যুদণ্ডও—আরোপ করা হতে পারে। কারণ এই ধরনের অপরাধ সমাজের মানসিক ও নৈতিক নিরাপত্তাকে বিপর্যস্ত করে। সুতরাং “পিতার কোনো শাস্তি নেই”—এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

ব্যক্তিগত অধিকারের দিক থেকে

এ দিক থেকেও পিতা শাস্তিমুক্ত নন। একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিকহি বিধান হলো—যে ব্যক্তি হত্যাকাণ্ড ঘটায়, সে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না। ফলে পিতা তাঁর নিহত সন্তানের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। তাই শরিয়ত ও আইনের দৃষ্টিতে তাঁকে উপেক্ষা করা হয় না।

মাতার ক্ষেত্রে কেন কিসাস?

মাতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই গভীর মমতা, কোমলতা ও সন্তানের সঙ্গে নিবিড় আবেগী সম্পর্কের প্রতীক। কোনো মায়ের পক্ষ থেকে সচেতন ও ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তান হত্যা হওয়া মানে তাঁর মানসিক ও মানবিক স্বাভাবিকতার চরম বিপর্যয়। এ ধরনের অপরাধ ইঙ্গিত দেয় যে তিনি মাতৃত্বের স্বাভাবিক গুণাবলি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়েছেন। তাই যদি কোনো মাতা জেনে-শুনে সন্তানকে হত্যা করেন, তবে তাঁর ক্ষেত্রে কিসাসের বিধান কার্যকর হয়। এটি মানবিক মর্যাদার বৈষম্য নয়; বরং নারী ও পুরুষের মানসিক প্রকৃতি এবং অপরাধের চরিত্র বিশ্লেষণের ফল।

শরিয়তের বিধান: ইবাদত ও তাআব্বুদ

এই প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এগুলো ফিকহের ফরঈ (শাখাগত) বিধান, এবং এগুলোর ভিত্তি হলো তাআব্বুদ, অর্থাৎ আল্লাহর আদেশের প্রতি আনুগত্য। প্রতিটি বিধানের পূর্ণ দর্শন বা হিকমত আমাদের কাছে স্পষ্ট নাও হতে পারে। কোনো বিধানের পেছনে একাধিক হিকমত থাকতে পারে, যার অনেকটাই মানুষের জ্ঞানের বাইরে।

উদাহরণস্বরূপ, মদ হারাম হওয়ার কারণ কেবল নেশা নয়। যদি সামান্য পরিমাণ মদ বিপুল পানিতে মিশে গিয়ে নেশা সৃষ্টি না করে, তবুও তা হারামই থাকবে। এতে বোঝা যায়, শরিয়তের বিধান কেবল আমাদের যুক্তি বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

একইভাবে, বিবাহ ও ব্যভিচারের পার্থক্যও কেবল বাহ্যিক নয়। কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে আকদের মাধ্যমে যে সম্পর্ক বৈধ হয়, তা কেবল বস্তুগত বিশ্লেষণে ব্যাখ্যা করা যায় না। এখানে আল্লাহর আদেশই মুখ্য।

এমনকি কেউ যদি কোনো বিধানের হিকমত জানেও, তবুও সেই হিকমত ইবাদতের নিয়তের বিকল্প হতে পারে না। নামাজ যদি কেউ কেবল শারীরিক বা মানসিক উপকারের জন্য আদায় করে, তবে তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না; ইবাদতের মূল হলো আল্লাহর আদেশ পালনের নিয়ত।

কিসাস প্রয়োগও বাধ্যতামূলক নয়

মাতার ক্ষেত্রে কিসাসের বিধান থাকলেও, তা অবশ্যই কার্যকর করতে হবে—এমন নয়। নিহতের উত্তরাধিকারীরা (যারা সাধারণত সন্তান বা স্বামী হন) চাইলে ক্ষমা করতে পারেন। বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার মাতা বা স্ত্রীকে কিসাস দিতে রাজি হয় না। ফলে বিধান থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ ঘটে না।

ইসলামের দণ্ডনীতি: প্রতিরোধমূলক দর্শন

সার্বিকভাবে ইসলামের দণ্ডনীতি শাস্তি কার্যকরের চেয়ে অপরাধ প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দেয়। শাস্তিগুলো কঠোরভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যেন মানুষ অপরাধ করতে ভয় পায়, সহজে শাস্তি প্রয়োগের জন্য নয়। এ কারণেই হুদুদ ও কিসাস কার্যকরের জন্য কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে এবং সামান্য সন্দেহ থাকলেও শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়—যেমন প্রবাদে বলা হয়েছে: সন্দেহের কারণে হুদুদ স্থগিত করা হয়।

উপসংহার

সুতরাং পিতা ও মাতার ক্ষেত্রে শাস্তির পার্থক্য কোনো বৈষম্যের প্রতিফলন নয়। বরং এর লক্ষ্য হলো সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষা, মানসিক স্থিতি বজায় রাখা এবং এমন ভয়াবহ অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা। ইসলামী শরিয়তের এই বিধানসমূহ মূলত প্রতিরোধমূলক, মানবসমাজের কল্যাণ ও নৈতিক ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যেই প্রণীত।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button