ইতিহাসজীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

ইসলামী দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক কাঠামোয় শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে হবে: উস্তাদ রাশাদ

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের তেহরান প্রদেশের হাওজা ইলমিয়া পরিষদের সভাপতি উস্তাদ রাশাদ রবিবার বলেছেন, মুসলিম বিশ্বকে তার ভৌত ও আধ্যাত্মিক সক্ষমতাকে সক্রিয় করে বৈশ্বিক মঞ্চে দৃঢ় ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, ইসলামী দেশগুলোকে নিজেদের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিক কাঠামোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজেদের জন্য বিশেষ অবস্থান তৈরি করতে হবে।

সম্ভাবনা বনাম বাস্তবতা

উস্তাদ রাশাদ বলেন, মুসলিমরা বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ নিয়ে গঠিত এবং সভ্যতা ও নৈতিকতার অগণিত সাধারণ মিল থাকলেও এখনও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় তার যথাযথ প্রভাব প্রতিপাদন করতে পারেনি। শান্তি ও ন্যায়বিচারের নামে প্রতিষ্ঠিত অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাস্তবে কখনো কখনো নিপীড়নকে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এবং জনসম্মুখে তাদের বৈধতাও হারিয়েছে।

শক্তির একীকরণ ও অসহযোগিতার কৌশল

উস্তাদ রাশাদ বলেন, যদি মুসলিম উম্মাহ তার বিশাল মানবসম্পদ ও নৈতিক সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাহসের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং তাদের সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়, তবে এসব প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়বে। তিনি এ ধরনের পদক্ষেপকে কেবল বিচ্ছিন্নতা বা অবহেলা হিসেবে দেখেন না; বরং এটিকে “পরিকল্পনামূলক অসহযোগিতা” এবং বৈশ্বিক নাগরিক প্রতিবাদ হিসেবে উল্লেখ করেন। এমন কার্যকর ঐক্য অন্যান্য নিপীড়িত জাতিগুলোকে অনুপ্রাণিত করবে এবং সীমান্ত ও ধর্মের ঊর্ধ্বে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।

ইমাম খোমেনির (রহ.) উদ্ধৃতি ও বাস্তব প্রয়োগ

উস্তাদ রাশাদ ইমাম খোমেনির (রহ.) বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “যদি মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হতো এবং প্রত্যেকে এক বালতি পানি ঢালত, তাহলে শত্রুকে সেই স্রোত ভাসিয়ে নিত।” তিনি উল্লেখ করেন, এই বাণী একতার শক্তির প্রতিফলন। তবে বাস্তবে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মঞ্চে অন্যায়ের প্রতিনিধির বক্তৃতায় মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া প্রায়ই কেবল সভা ত্যাগ বা প্রতীকী প্রতিবাদ পর্যন্ত সীমিত থাকে। গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটি, নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক সরঞ্জাম বন্ধের ক্ষেত্রে মুসলিম কণ্ঠ একক ও সমন্বিতভাবে উচ্চারিত হয় না। এতে স্পষ্ট হয় সম্ভাবনা ও বাস্তব কর্মকাণ্ডের মধ্যে গভীর ফাঁক।

আন্তর্জাতিক আদালত ও প্রতীকী রায়ের সীমাবদ্ধতা

উস্তাদ রাশাদ আন্তর্জাতিক আদালতসমূহ, বিশেষ করে হেগের ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহের রায় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “কোনো অপরাধীকে দোষী ঘোষণা করা যদি কার্যকর বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত না হয় এবং কেবল প্রতীকী নিষেধাজ্ঞার সীমিত থাকে, তাহলে কি তা সত্যিকারের ন্যায়বিচার পৌঁছে দিতে সক্ষম?” প্রতীকী রায় জনমতকে সচেতন রাখতে সহায়তা করে—কিন্তু যারা তাদের সন্তান হারিয়েছে, তাদের জন্য তা যথেষ্ট নয়। যে বিচার ব্যবস্থা রক্তপাত বন্ধ করতে ব্যর্থ, তার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

কৌশলগত বিকল্প: উদ্যোগ ও সমন্বিত বয়কট

উস্তাদ রাশাদ বলেন, ইসলামী বিশ্বের প্রকৃত শক্তি নির্ভর করে “খেলার নিয়ম” পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে এবং বিকল্প নৈতিক ও কার্যকর কাঠামো গড়ে তুলতে পারার ক্ষমতার ওপর। তিনি বর্তমান বিচ্ছিন্ন ও প্রতীকী বয়কট প্রক্রিয়াগুলো সমালোচনা করে বলেন, এর পরিবর্তে একটি বহুমাত্রিক, সমন্বিত ও কৌশলগত বয়কট রণনীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন—যাতে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতাগুলো একসাথে প্রয়োগ করা যায়।

তিনি তিনটি প্রধান প্রস্তাব করেন:

  • অর্থনৈতিক বয়কট — ঐক্যবদ্ধ আর্থিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, যা মুসলিম উম্মাহর “নীরব অস্ত্র” হিসেবে কাজ করবে।
  • কূটনৈতিক বয়কট— কেবল সম্মেলন, মৌখিক বর্জন নয়; সম্পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন, রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার, ইসলামি সংস্থাগুলো থেকে আগ্রাসী রাষ্ট্রের স্থায়ী বহিষ্কার এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ইভেন্টে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা।
  • সামরিক ও নিরাপত্তা বয়কট— আগ্রাসী রাষ্ট্রকে অস্ত্র, প্রযুক্তি ও সামরিক প্রশিক্ষণ সরবরাহ বন্ধ করা; আকাশসীমা ও ঘাঁটিগুলো ব্যবহার নিষিদ্ধ করে তার আক্রমণাত্মক সক্ষমতা দুর্বল করা।

উস্তাদ রাশাদ বলেন, যদি মুসলিম উম্মাহ তাদের সমষ্টিগত শক্তি উপলব্ধি করে এবং প্রতীকী প্রতিবাদের বাইরে এসে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে সমন্বিত, বহুমাত্রিক ও বুদ্ধিদীপ্ত বয়কট প্রয়োগ করে, তবে তা শুধু অন্যায়পূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করবে না, বরং মুসলিম বিশ্বকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার নীতিনির্ধারণে একটি প্রভাবশালী খেলোয়াড়ে পরিণত করবে। এই পথ যদি দৃঢ় সংকল্প, একক কৌশল ও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের মাধ্যমে অতিক্রম করা হয়, তবে তা ইসলামী সভ্যতার পুনরুজ্জীবন ঘটাবে এবং নিপীড়িতদের জন্য একটি শক্তিশালী আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করবে।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button