বিশ্ববিশেষ সংবাদসংবাদ বিশ্লেষণ

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী: এই মুহূর্তে আমেরিকার সঙ্গে আলোচনায় কোনো সুফল নেই

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির:গত মঙ্গলবার রাতে ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ খামেনেয়ী জনগণের উদ্দেশ্যে টেলিভিশন ভাষণে বলেন, “ইরানি জাতির অবিচল ঐক্য ও সংহতি শত্রুর মাথার উপর ইস্পাতের ঘুষির মতো।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন কেন গর্বিত ইরানি জাতি শত্রুর চাপ ও হুমকির সামনে আত্মসমর্পণ করেনি এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। তিনি জোর দিয়ে বলেন:
“যে আলোচনার ফলাফল আমেরিকা আগে থেকেই নির্ধারণ ও চাপিয়ে দেয়, তা নিরর্থক ও ক্ষতিকর। কারণ এতে শত্রুর আরও নতুন দাবি চাপিয়ে দেওয়ার লোভ বাড়ে এবং কোনো ক্ষতি প্রতিরোধ হয় না। এমন আলোচনা কোনো সম্মানিত জাতি বা জ্ঞানী রাজনীতিক মেনে নিতে পারে না।

ভাষণের মূল অংশ

১. শিক্ষা ও তরুণদের গুরুত্ব

ভাষণের শুরুতে তিনি নতুন শিক্ষাবর্ষ (মাহে মেহর) উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানান এবং বলেন:

১.কোটি কোটি শিশু-কিশোর ও তরুণদের জ্ঞানের পথে যাত্রা একটি মহান সম্পদ।

২.শিক্ষা মন্ত্রণালয়, উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তরুণদের অসাধারণ প্রতিভার মূল্য বুঝতে হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক দুই মাসে ইরানি ছাত্ররা বিশ্ব প্রতিযোগিতায় ৪০টি পদক জিতেছে (১১টি স্বর্ণপদকসহ)। যুদ্ধ ও সংকট সত্ত্বেও তারা জ্যোতির্বিদ্যায় বিশ্বসেরা হয়েছে, কুস্তি, ভলিবলসহ নানা খেলায় সাফল্য পেয়েছে।

২. শহীদদের স্মরণ

১.খামেনেয়ী শহীদ সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে (লেবাননের প্রতিরোধ নেতা) ইসলামের, শিয়াদের ও লেবাননের বিশাল সম্পদ হিসেবে অভিহিত করেন।

২.তিনি জোর দিয়ে বলেন, তাঁর রেখে যাওয়া সম্পদ তথা হিজবুল্লাহ অমূল্য এবং তা সংরক্ষণ করা জরুরি।

৩.বারো দিনের যুদ্ধে শহীদ হওয়া সকল সেনাপতি, বিজ্ঞানী ও শহীদ পরিবারকে আন্তরিক সমবেদনা জানান।

৩. তিনটি মূল বিষয়

তিনি বলেন, ভাষণে তিনটি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে:

১. ইরানি জাতির ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব।

২. ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মূল্য।

৩. আমেরিকার হুমকির সামনে দৃঢ় অবস্থান।

৪. জাতীয় ঐক্যের ভূমিকা

১. তিনি বলেন, শত্রু কমান্ডারদের হত্যা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল যাতে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামানো যায়।

২. কিন্তু বিপরীতে জনগণ আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে ও প্রজাতন্ত্রের পক্ষে বিপুল সংখ্যায় রাস্তায় নামে।

৩. এভাবেই জনগণের ঐক্য শত্রুর ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল করেছে।

তিনি সমালোচনা করেন যারা বলে যে ঐক্য কেবল যুদ্ধের সময় ছিল:
এটি সম্পূর্ণ ভুল। আজও ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী তাদের ‘ইরানি পরিচয়’ নিয়ে গর্ব করে। রাজনৈতিক মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে তারা এক ইস্পাতমুষ্টি।

৫. ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও পারমাণবিক প্রযুক্তি

১. খামেনেয়ীবলেন, কেন শত্রু সমৃদ্ধকরণকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে তা বোঝা জরুরি।

২. ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কৃষি, শিল্প, চিকিৎসা, পরিবেশ, গবেষণা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা ক্ষেত্রে অপরিসীম উপকারী।

৩. ইরান এ প্রযুক্তি স্বতন্ত্রভাবে অর্জন করেছে, কেউ দেয়নি।

৪. বর্তমানে ইরান বিশ্বের মাত্র ১০টি দেশের মধ্যে একটি যারা এই শিল্পে সক্ষম।

৫. তিনি বলেন: “আমরা পরমাণু অস্ত্র বানানোর সিদ্ধান্ত নেইনি। কিন্তু আমরা ৬০% পর্যন্ত সমৃদ্ধকরণ করেছি, যা মূল্যবান।”

৭.শত্রুর বোমাবর্ষণে প্রযুক্তি ধ্বংস হবে না, কারণ ইরানে হাজারো বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী তৈরি হয়েছে।

৬. আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে

১. খামেনেয়ী বলেন, আমেরিকা বারবার চাপ দিয়েও ইরানকে নত করতে পারেনি।

২. আগে তারা বলেছিল, উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধকরণ করবেন না; এখন বলছে, একেবারেই সমৃদ্ধকরণ করবেন না।

৩. এর মানে তারা চায় ইরান তার অর্জন ধ্বংস করে ফেলুক—কিন্তু ইরান কখনো তা মেনে নেবে না।

তিনি ব্যাখ্যা করেন কেন আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা ক্ষতিকর:

১. আমেরিকা আগে থেকেই ফলাফল চাপিয়ে দেয় (যেমন সমৃদ্ধকরণ বন্ধ, ক্ষেপণাস্ত্র না রাখা)।

২. এমন আলোচনায় বসা মানে শত্রুর চাপ ও দিকনির্দেশ মেনে নেওয়া।

৩. ভীতি ও দুর্বলতা প্রকাশ পায়, যা শত্রুকে আরও দাবিদাওয়া করতে উৎসাহিত করে।

৪. পূর্ব অভিজ্ঞতা (পরমাণু চুক্তি / JCPOA) দেখিয়েছে আমেরিকা প্রতিশ্রুতি ভেঙেছে, নিষেধাজ্ঞা তুলেনি, বরং চুক্তি থেকেও বেরিয়ে গেছে।

তিনি বলেন:
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা ইরানের জন্য কোনো সুফল আনে না, বরং বড় ক্ষতি বয়ে আনে।

৭. উপসংহার

১. একমাত্র সমাধান হলো দেশের সর্বক্ষেত্রে (সামরিক, বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক) শক্তিশালী হওয়া।

২. যখন দেশ শক্তিশালী হবে, শত্রু আর হুমকি দেওয়ার সাহসও করবে না।

৩. খামেনেয়ী শেষে আল্লাহর উপর ভরসা ও ইমামদের (আ.) প্রতি তাওয়াসসুল করার পরামর্শ দেন এবং বলেন:জাতীয় ঐক্য ও চেষ্টা অব্যাহত থাকলে আল্লাহর কৃপায় সব কাজে সাফল্য আসবে।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button