ইতিহাসধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

ইরানের জাতীয় ঐক্য সেই ২৩ খোরদাদের ঐক্যেরই ধারাবাহিকতা; এই ঐক্য রক্ষায় সবাই দায়বদ্ধ

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৪ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ  আলী খামেনেয়ী সম্প্রতি  এক টেলিভিশন ভাষণে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন— জাতীয় ঐক্য ও পারস্পরিক সংহতি আজও ইরানি জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি এবং শত্রুর বিরুদ্ধে অটল প্রতিরোধের প্রতীক। তিনি সতর্ক করে দেন, এই ঐক্য যেন ক্ষণস্থায়ী কোনো ঘটনা হিসেবে না দেখা হয়; বরং এটি হতে হবে অব্যাহত ও কার্যকর একটি জাতীয় দায়িত্ব, যেখানে জনগণ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তা—সকলেই সমানভাবে দায়বদ্ধ।

এই ভাষণে তিনি জাতীয় ঐক্যের পাশাপাশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা ব্যাখ্যা করেন।

জাতীয় ঐক্য, পরমাণু প্রযুক্তি ও মার্কিন আলোচনার প্রসঙ্গ

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ  আলী খামেনেয়ী টেলিভিশন ভাষণে ইরানের জনগণের উদ্দেশে বলেন— ইরানের জাতীয় ঐক্য ও একতা হচ্ছে “২৩ খোরদাদ” (২৩ জুন)-এর সেই জাতীয় ঐক্যেরই ধারাবাহিকতা, যা আজও শত্রুর বিরুদ্ধে ইরানের মুষ্টিবদ্ধ প্রতিরোধকে প্রতিফলিত করে।

তিনি বলেন, ইরানি জাতি কখনোই শত্রুর চাপ বা ভয় দেখানোয় আত্মসমর্পণ করবে না, বিশেষ করে উপকারী পরমাণু প্রযুক্তি ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অধিকার থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রশ্নে নয়।
তার ভাষায়, “যে আলোচনার ফলাফল শত্রু আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেয়, সেই আলোচনা কেবল অর্থহীন নয়, বরং ক্ষতিকরও। এমন আলোচনা কেবল অহংকারী শক্তিকে আরও লোভী করে তোলে, এবং কোনো ক্ষতি দূর করতেও সক্ষম হয় না। এই ধরনের আলোচনায় কোনো সম্মানিত ও প্রজ্ঞাবান জাতি অংশ নেয় না।”

শিক্ষা, যুবসমাজ ও প্রতিভা বিকাশের প্রসঙ্গ

ভাষণের শুরুতে তিনি শিক্ষাবর্ষের শুরু-এর শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন: “এই মাসে কোটি কোটি শিশু, কিশোর ও তরুণ জ্ঞানের পথে যাত্রা শুরু করে। দায়িত্বশীলরা—বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়—তাদের প্রতিভাকে বোঝে এবং এই ঈশ্বরপ্রদত্ত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করবে।”

তিনি উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ইরানি শিক্ষার্থীরা ৪০টি পদক অর্জন করেছে, যার মধ্যে ১১টি সোনা।

যুদ্ধ ও চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তারা বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও সাফল্য এনেছে। খামেনেয়ী আরও বলেন, “এই জাতির তরুণরাই আজ কুস্তি, ভলিবলসহ নানা খেলায় বিশ্বমঞ্চে গৌরব অর্জন করছে; এটি প্রমাণ করে ইরানি জাতির প্রতিভা ও মনোবল কত উচ্চ।”

শহীদ সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ও ‘১২ দিনের যুদ্ধ’-এর প্রসঙ্গ

তিনি লেবাননের প্রয়াত নেতা শহীদ সায়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে ইসলামি বিশ্ব ও শিয়া সমাজের এক “অমূল্য সম্পদ” হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ যে সম্পদ সৃষ্টি করেছেন—তা শুধু হিজবুল্লাহ নয়, বরং ইসলামী প্রতিরোধের ধারাবাহিক শক্তি। এই সম্পদকে অবহেলা করা চলবে না।”

তিনি যুদ্ধের শহীদদের পরিবারকে আন্তরিক সমবেদনা জানান এবং তার বক্তব্যের তিনটি মূল বিষয় নির্ধারণ করেন:

১. ইরানের জনগণের ঐক্যের গুরুত্ব,

২.  ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তা,

৩. যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি ও আলোচনার বিষয়ে ইরানের দৃঢ় অবস্থান।

১. জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব

তিনি বলেন, ১২ দিনের যুদ্ধের সময় ইরানি জাতির ঐক্যই ছিল শত্রুর পরাজয়ের প্রধান কারণ।
শত্রু ইরানের ভিতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে, কারণ জনগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পক্ষে রাস্তায় নেমেছিল।

তিনি বলেন, “শত্রু ভেবেছিল জনসাধারণকে উত্তেজিত করে দেশকে বিপর্যস্ত করবে। কিন্তু ইরানের জনগণ ঐক্যবদ্ধ থেকে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই ঐক্য এখনো বিদ্যমান এবং আরও দৃঢ়।”

তিনি আরও যোগ করেন, “কেউ কেউ বলে ঐক্য কেবল যুদ্ধের সময় ছিল—এটি ভুল ধারণা। আজও ইরানের প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী তাদের ইরানি পরিচয়ে গর্বিত।”

২. ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের গুরুত্ব

আয়াতুল্লাহ  খামেনেয়ী বলেন, “আমাদের বিশেষজ্ঞদের উচিত জনগণকে বোঝানো কেন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এত গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন— ইরানে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ায় পরিশোধিত হয়ে মূল্যবান সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামে পরিণত হয়, যা কৃষি, শিল্প, পরিবেশ, চিকিৎসা, খাদ্য, গবেষণা এবং শিক্ষা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

তিনি বলেন, “সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনও সম্ভব, যা সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব। অনেক উন্নত দেশই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহার করছে, অথচ আমরা এখনো গ্যাস ও তেল ব্যবহার করি।”

তিনি জানান, ইরান ৩০ বছরের প্রচেষ্টায় নিজস্ব প্রযুক্তিতে ৬০% পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে, যা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে এবং আইনসঙ্গতভাবে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের কাতারে স্থান দিয়েছে।

তিনি সতর্ক করে বলেন, “কয়েকটি দেশ ৯০% পর্যন্ত সমৃদ্ধ করে অস্ত্র বানায়, কিন্তু আমরা তা করিনি এবং করবও না, কারণ আমাদের নীতিই হলো—পরমাণু অস্ত্র নয়।”

৩. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে অবস্থান

আয়াতুল্লাহ  খামেনেয়ী বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা সম্পূর্ণভাবে অর্থহীন ও ক্ষতিকর। এতে জাতির কোনো লাভ নেই, বরং ক্ষতি আছে।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন, “আমেরিকা চায় আলোচনার ফল আগে থেকেই নির্ধারিত থাকুক—অর্থাৎ ইরানকে তার পরমাণু কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। এটি আলোচনা নয়, বরং চাপ প্রয়োগ।”

তিনি উল্লেখ করেন, “তাদের এক সহকারী সম্প্রতি বলেছে—ইরান এমনকি মাঝারি বা স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রও রাখবে না। অর্থাৎ তারা চায় ইরানকে এত দুর্বল করে দিক যে কোনো আগ্রাসনের জবাবও দিতে না পারে।”

আয়াতুল্লাহ  খামেনেয়ী এই দাবিকে “অবিবেচক ও অবাস্তব” বলে অভিহিত করেন এবং বলেন: “এই জাতি ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের চরিত্র সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই।”

তিনি আরও বলেন, “আমেরিকার সঙ্গে এমন আলোচনায় অংশ নেওয়া মানে হলো ভয় ও আত্মসমর্পণ প্রদর্শন করা। এতে শত্রু আরও সাহস পায় এবং তার দাবি সীমাহীন হয়।”

তিনি ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি (ব্রাজাম)–এর উদাহরণ টেনে বলেন, “আমরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি, কিন্তু আমেরিকা তা ভঙ্গ করেছে। তারা চুক্তি ছিঁড়ে ফেলেছে, নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়িয়েছে। এটি আমাদের জন্য শিক্ষা।”

চূড়ান্ত বার্তা: শক্তিশালী ইরানই সমাধান

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, “আমাদের পথ একটাই—সব ক্ষেত্রে শক্তিশালী হওয়া। সামরিক, বৈজ্ঞানিক, প্রশাসনিক ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হলে কেউ আর হুমকি দিতে পারবে না।”

তিনি জনগণকে আল্লাহর প্রতি ভরসা ও আহলে বায়েত (আ.)–এর শাফাআতের ওপর নির্ভর করতে আহ্বান জানান এবং বলেন, “জাতীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাজ এগিয়ে নিতে হবে। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহর তৌফিকে বিজয় আমাদেরই হবে।”

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button