ইমাম হাসান আসকারী(আ.)এর হাদিস বিশ্লেষণ: কুরআনের অর্থ ঠিক হলেও, জ্ঞানহীনতা দূর হয় না
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: কুরআন শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি এক মহাজ্ঞানভাণ্ডার—যার প্রতিটি আয়াত বহন করে বহুস্তর অর্থ, আধ্যাত্মিক ইঙ্গিত ও জীবনদর্শনের দিশা। এই বিশাল ও গভীর অর্থবোধের ব্যাখ্যা কোনো সাধারণ ব্যক্তির কাজ নয়। ইসলামী ঐতিহ্য ও নবীজির সুস্পষ্ট নির্দেশনা অনুযায়ী, কুরআনের প্রকৃত ব্যাখ্যা ও তাফসিরের একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে আহলে বাইতের হাতে—যাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত, পবিত্র ও নির্ভুল।
আহলে বাইতের একচ্ছত্র নেতৃত্বে কুরআনের ব্যাখ্যা ও তাফসিরের ধারণা শুধু কুরআনের আয়াত ও নবী-পরিবারের হাদিসের ভিত্তিতেই নয়, বরং এটি যুগে যুগে ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। নবী করিম (সা.) ও ইমামগণের জীবনচর্চা বারবার এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, কুরআনের গভীর অর্থ বুঝতে হলে চাই এক নির্ভুল, পবিত্র ও আল্লাহপ্রদত্ত ব্যাখ্যাকারী।
আল্লাহ বলেন:
﴿وَأَنزَلْنَا إِلَیْكَ الذِّكْرَ لِتُبَیِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَیْهِمْ﴾ — [সূরা নাহল, আয়াত ৪৪] “আমি তোমার কাছে ‘যিকর’ (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষের জন্য তা ব্যাখ্যা করো।”
এই আয়াত নবীজির ব্যাখ্যাদানের দায়িত্ব স্পষ্ট করে দেয়। তাঁর পর, এই দায়িত্ব হস্তান্তরিত হয় আহলে বাইতের প্রতি, যাঁরা কুরআনের প্রকৃত ব্যাখ্যাকারী ও রক্ষক।
নবী করিম (সা.) বলেন:
«إِنِّی تَارِكٌ فِیكُمُ الثَّقَلَیْنِ: كِتَابَ اللَّهِ وَ عِتْرَتِی أَهْلَ بَیْتِی، وَ إِنَّهُمَا لَنْ یَفْتَرِقَا…» “আমি তোমাদের মাঝে দুটি ভার রেখে যাচ্ছি: আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত। এ দুটো কখনো আলাদা হবে না।”
এই হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা আহলে বাইতের দিশা ছাড়া অসম্ভব। তাঁদের ব্যতীত অন্য কোনো উৎস থেকে ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে তা “তাফসিরে রায়”—অর্থাৎ ব্যক্তিগত মতামতভিত্তিক ব্যাখ্যা—হিসেবে গণ্য হয়, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
ইমাম হাসান আসকারি (আ.) বলেন:
فَأَمَّا مَنْ قَالَ فِی الْقُرْآنِ بِرَأْیِهِ، فَإِنِ اتَّفَقَ لَهُ مُصَادَفَةُ صَوَابٍ، فَقَدْ جَهِلَ فِی أَخْذِهِ عَنْ غَیْرِ أَهْلِهِ، وَ كَانَ كَمَنْ سَلَكَ طَرِیقاً مَسْبَعاً مِنْ غَیْرِ حُفَّاظٍ یَحْفَظُونَهُ فَإِنِ اتَّفَقَتْ لَهُ السَّلَامَةُ، فَهُوَ لَا یَعْدَمُ مِنَ الْعُقَلَاءِ وَ الْفُضَلَاءِ الذَّمَّ [وَ الْعَذْلَ] وَ التَّوْبِیخَ …
যে ব্যক্তি নিজের মতামত অনুযায়ী কুরআনের ব্যাখ্যা করে, সে যদি কাকতালীয়ভাবে সঠিকও বলে, তবুও সে অজ্ঞই রয়ে যায়। কারণ সে জ্ঞান আহরণ করেছে এমন উৎস থেকে, যা আহলে বাইত নয়। তার অবস্থা সেই ব্যক্তির মতো, যে হিংস্র জন্তুদের পথে রক্ষী ছাড়া চলেছে। সে যদি বেঁচে যায়, তবুও জ্ঞানীরা তাকে তিরস্কার করবে। আর যদি ধ্বংস হয়, তবে সে শুধু দুনিয়া নয়, আখিরাতেও মর্যাদা হারাবে।
ইমাম আসকারি (আ.) এই হাদিসে ব্যাখ্যা করেছেন যে, ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার ক্ষতি দ্বিমুখী:
১.আখিরাতের ধ্বংস: নিজের মতামত দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করলে জাহান্নামের যোগ্যতা অর্জিত হয়।
২.দুনিয়ার মর্যাদাহানি: জ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের চোখে সে বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।
এই ভুল ব্যাখ্যাকারীকে তুলনা করা হয়েছে এমন এক ব্যক্তির সঙ্গে, যে ঝড়ে-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে, নাবিকহীন ও ভাঙা নৌকায় যাত্রা করেছে। তার ধ্বংস অনিবার্য, এবং কেউ তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে না—কারণ সে নিজেই সঠিক পথ ত্যাগ করেছে।
এই জন্যই আহলে বাইতের নেতৃত্বে কুরআনের ব্যাখ্যা শুধু একটি ধর্মীয় তত্ত্ব নয়, বরং এটি একটি জীবনরক্ষা কারী নীতি—যা ধর্মের বিশুদ্ধতা ও মানুষের মুক্তির জন্য অপরিহার্য।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সালমান ফারসি, আবু যর গিফারি, জাবির জুআফি, আবা বসির, আলী ইবনে ইব্রাহিম কুমি—এমন বহু সাহাবি ও তাবেঈন কুরআনের জটিল প্রশ্নে সরাসরি ইমামদের কাছে ফিরে গেছেন। তাঁদের জীবনচর্চা প্রমাণ করে, ব্যক্তিগত যুক্তি বা অনুমান নয়, বরং আহলে বাইতের নির্দেশনাই ছিল একমাত্র নির্ভরযোগ্য পথ।
জাবির জুআফির মতো ব্যক্তিত্ব, যিনি ইমাম বাকির (আ.) থেকে অসংখ্য তাফসির ও আকিদার হাদিস বর্ণনা করেছেন, নিজেকে কখনো স্বাধীন ব্যাখ্যাকারী ভাবেননি। বরং তিনি ছিলেন এক বিশ্বস্ত বাহক—যিনি আল্লাহর জ্ঞানকে নির্ভুলভাবে গ্রহণ করে তা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন।



