ইমাম সাদিক (আ.) এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য রক্ষা
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন| প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইমাম সাদিক (আ.) কিভাবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য রক্ষা করতেন?
তিনি ঐক্যকে বিভিন্নতার অস্বীকারে নয়, বরং ঈশ্বরীয় সাধারণ নীতি ও নৈতিক মূল্যের আলোতে বৈচিত্র্যকে গ্রহণে দেখতেন এবং এটি মুসলিম উম্মাহর স্থিতিশীলতা ও দৃঢ়তার মূলমন্ত্র হিসেবে গণ্য করতেন।
দেওয়ালবিহীন বিশ্ববিদ্যালয় ও বৈচিত্র্যময় শিক্ষার্থীরা
ইমাম সাদিক (আ.)-এর ইমামত যুগটি ইসলামী বিশ্বের তাত্ত্বিক বিতর্কের চূড়ান্ত উত্তরণ এবং বিভিন্ন মতবাদের উদয়কালে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ভিত্তি পরীক্ষা করার একটি ময়দান ছিল। তিনি বিভিন্ন ধারার ছাত্রদের গ্রহণ করেছিলেন—আবু হানিফা ও মালিক ইবন আনসের মতো সুন্নি ঐতিহ্য থেকে শুরু করে শিয়া শিক্ষাবিদ পর্যন্ত।
তিনি এমন একটি “দেওয়ালবিহীন বিশ্ববিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে শিক্ষা দেওয়া হতো কোনো ধর্মীয় পূর্বশর্ত ছাড়াই।
সামাজিক সংযোগ ও আলোচনার নীতি
ইমামের বাড়ি ছিল সুন্নিদের বড় ব্যক্তিত্বদের আসার-যাওয়ার স্থান এবং তাদের সামাজিক ও শিক্ষাগত সমস্যার সমাধানের কেন্দ্র। তিনি “আডাবুল কথোপকথন” এবং “জিদাল আহসান” (সর্বোত্তম বিতর্ক) এর ওপর গুরুত্বারোপ করতেন। তাত্ত্বিক বিরোধীদের তিনি কখনো বহিষ্কার বা অবজ্ঞা করতেন না; বরং যুক্তি ও দয়া দ্বারা তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
ইমামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল শিয়া সুন্নিদের নামাজে ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা। এটি কেবল তাকিয়া বা আত্মসংরক্ষণের চেয়ে অনেক বেশি, বরং পারস্পরিক সম্মান ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য রক্ষার একটি চিহ্ন হিসেবে গণ্য হতো।
চ্যালেঞ্জপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে বুদ্ধিমত্তার উদাহরণ
ইমাম সাদিক (আ.) ঐক্যবদ্ধ নীতি অনুসরণ করতেন এমন সময়ে যখন উমায়্য ও আব্বাসী শাসনব্যবস্থা রাজনৈতিক পরিবেশকে কঠোরভাবে নিরাপত্তামূলক করে তুলেছিল, এবং বিভিন্ন ধারার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ক্ষমতাসীনদের সন্দেহের জন্ম দিতে পারত। তবু, তিনি সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সঙ্গে বৌদ্ধিক ও নৈতিক সীমারেখা বজায় রেখেছিলেন, এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাতেন।
বৈজ্ঞানিক বিতর্কের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
ইমামের বৈজ্ঞানিক বিতর্ক সুন্নি চিন্তাবিদ ও এমনকি অমুসলিমদের সঙ্গে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি কখনো ব্যক্তিগত কলহে প্রবেশ করতেন না, বরং কুরআন ও নবীর সুন্নতের ভিত্তিতে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতেন যেখানে সম্মানই প্রতিটি কথোপকথনের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হত। এই পদ্ধতির ফলে বহু বৌদ্ধিক বিরোধী কেবল তাঁদের শত্রুভাব পরিবর্তন করেনি, বরং ইমামের বন্ধু ও ছাত্রের দলে যুক্ত হয়েছেন।
আজকের যুগে প্রাসঙ্গিকতা
আজকের দিনে যখন তাকফিরি ও উগ্রপন্থী আন্দোলনগুলো ধর্মের নাম ব্যবহার করে বিভাজন ও সহিংসতা ছড়াচ্ছে, তখন ইমাম সাদিক (আ.)-এর জীবনদর্শনে ফিরে যাওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। তাঁর পদ্ধতি—যা নৈতিকতা, যুক্তি ও সামাজিক অংশগ্রহণের উপর ভিত্তি করে—মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আস্থা ও সংযোগ পুনঃস্থাপনের পথ প্রদর্শন করতে পারে, এবং একই সঙ্গে শত্রুদের বিভাজনমূলক প্রকল্পের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধকে শক্তিশালী করতে সক্ষম।