বিশেষ সংবাদধর্ম ও বিশ্বাসবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

আল-আকসা তুফান: জায়োনিস্টদের অপমান ও দখলদার ইসরায়েলের অজেয়তার মিথের অবসান

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৬ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসরায়েল বহু দশক ধরে নিজেদের জন্য এক অজেয় সামরিক শক্তি, সর্বশক্তিমান গোয়েন্দা ক্ষমতা এবং নিঃশর্ত নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের এক মিথ্যা চিত্র তৈরি করেছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের সকালেই ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের আল-আকসা তুফান” অভিযান সেই চিত্রটিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এক সকালেই ভেঙে পড়ে “অজেয় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী”-র কিংবদন্তি মিথ ।

এক ভোরে বিশ্বজাগরণ

 আল-আকসা তুফান” কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়; এটি পরিণত হয়েছে এক বৈশ্বিক নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক জাগরণে।

ফিলিস্তিন আলেম পরিষদের সভাপতি নওয়াফ তাকরুরি, তুরস্কের সংবাদমাধ্যম “ইলকে”  দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন— “এই অভিযান দখলদারদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করেছে। দীর্ঘ বিশ্বাসঘাতকতা ও অবহেলার পর এটি ফিলিস্তিনের আদর্শকে নতুন প্রাণ দিয়েছে।”

অজেয় সেনাবাহিনীর মিথ ভাঙনের সকাল

ইসরায়েল দশকের পর দশক ধরে নিজেদের অজেয় হিসেবে প্রচার করেছিল— বিশ্বের সেরা সেনা, মোসাদের সর্বব্যাপী নজরদারি, এবং এক অভেদ্য সীমানা। কিন্তু ৭ অক্টোবর ২০২৩ সেই মিথকে ভেঙে দেয় ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পরিকল্পিত আঘাত। তারা সীমান্ত ভেদ করে সামরিক ঘাঁটিতে প্রবেশ করে, সৈন্য আটক করে, এমনকি কিছু ঘাঁটি অস্থায়ীভাবে দখল করে নেয়।

এ ঘটনা কেবল সামরিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক ও কৌশলগতভাবে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আঘাত। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমন অপমান তারা কখনো দেখেনি।

এই অভিযানের পর প্রকাশ্যে আসে ইসরায়েলের ভয়াবহ অপরাধসমূহ — হাসপাতাল, স্কুল ও মসজিদ ধ্বংস; নারী ও শিশু হত্যার দৃশ্য; এবং পশ্চিমা বিশ্বের মানবাধিকার মুখোশের আড়ালের নির্মম বাস্তবতা।

গণহত্যা নয়, ভয়ের প্রতিক্রিয়া

অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় শুরু করে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ। আকাশ-স্থল-বোমা হামলা, খাদ্য ও জ্বালানির অবরোধ, এবং পরিকল্পিত গণহত্যা— সবই যেন এক উন্মত্ত প্রতিশোধের বহিঃপ্রকাশ।

তবে নওয়াফ তাকরুরির ভাষায়, “এই বর্বরতা ইসরায়েলের আত্মবিশ্বাসের নয়, বরং অপমান ও ভয়ের ফল। তারা হারানো মর্যাদা ফেরাতে হত্যা করছে। প্রতিটি বোমা তাদের দুর্বলতাকেই উন্মোচিত করছে।”

গাজায় এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারের বেশি শহীদ এবং ১ লক্ষ ৭০ হাজারেরও বেশি আহত
তবু গাজার মানুষ আত্মসমর্পণ করেনি। তাদের দৃঢ়তা ও বিশ্বাসই আজ ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন।

সীমান্ত পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়া ঝড়

“আল-আকসা তুফান” গাজার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; এটি আজ বৈশ্বিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস, মাদ্রিদ, জাকার্তা, কেপটাউন — সর্বত্র লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়েছে।

বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ পশ্চিমা সরকারের দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। যেসব দেশ গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায়, তারাই জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ভেটো দিয়ে ভন্ডুল করছে এবং ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করছে।

অন্যদিকে স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে নৈতিক ও সাহসী অবস্থান নিয়েছে। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের তথাকথিত “নৈতিক নেতৃত্ব” আজ মারাত্মক প্রশ্নের মুখে।

অচল হয়ে পড়েছে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া

অক্টোবর ২০২৩-এর আগে একাধিক আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে দ্রুত এগোচ্ছিল। কিন্তু “আল-আকসা তুফান” সেই প্রক্রিয়াকে প্রায় সম্পূর্ণ থামিয়ে দেয়।

মুসলিম বিশ্বের জনমত এখন একবাক্যে বলছে — ফিলিস্তিন বিক্রয়ের জন্য নয়।”

যেসব আরব শাসক অতীতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন, আজ তারা নিজ জনগণের চোখে লজ্জিত।
তাকরুরি বলেন — “অসৎ নেতারা হয়তো দখলদারকে আলিঙ্গন করতে চায়, কিন্তু মুসলিম জাতির জনগণ স্পষ্ট করে দিয়েছে: কোনো চুক্তি বা স্বাভাবিকীকরণ ফিলিস্তিনকে বিক্রি করতে পারবে না।”

মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত জনরোষ সরকারগুলোকে বাধ্য করছে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে।

মাঠের যোদ্ধাদের বাদ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নয়

নওয়াফ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর তথাকথিত “শান্তি পরিকল্পনা”কে তাকরুরি তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন । তার মতে, এটি আসলে নতুন এক সাইক্‌স-পিকো” ষড়যন্ত্র— উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা।

তিনি বলেন— “এটি কোনো শান্তিচুক্তি নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যকে নতুনভাবে বিভক্ত করে ইসরায়েলি-আমেরিকান আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ছক। গাজা বা ফিলিস্তিন বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তই মাঠের যোদ্ধাদের মতামত ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়।”

তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, “ট্রাম্পের পরিকল্পনা গাজা থেকে ইসরায়েলের প্রত্যাহার নয়, বরং গাজার ওপর বহিঃনিয়ন্ত্রণ আরোপের ছক। এটি উপনিবেশিক প্রশাসন তৈরির প্রচেষ্টা— নাম শান্তি, আসলে দখলের নতুন রূপ।”

শান্তির মুখোশে দখল সম্প্রসারণ

তাকরুরির মতে, প্রকৃত শান্তিচুক্তির তিনটি মৌলিক শর্ত থাকা উচিত —
১️.  ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার,
২️. ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি,
৩️.  স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি।

যে পরিকল্পনাটি প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে এসবের কোনোটিই নেই। বরং এটি আরব রাষ্ট্রগুলোকেও দখলের ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা। তার ভাষায়, “এই তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা হত্যাযজ্ঞ বা বাস্তুচ্যুতি বন্ধ করবে না; বরং আরও বাড়িয়ে তুলবে।”

মানবতার নৈতিক পুনর্জাগরণ

“আল-আকসা তুফান” শুধু সামরিক অভিযানের সাফল্য নয়; এটি এক নৈতিক বিপ্লবের সূচনা। গাজার শিশু, মায়েদের দৃঢ়তা ও যোদ্ধাদের আত্মত্যাগ বিশ্বমানবতার বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে।

আজ বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ করছে, সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে ।
তাদের প্রশ্ন— “মানবাধিকার কি কেবল পশ্চিমাদের জন্য?”

এই আন্দোলন এখন আফ্রিকার দক্ষিণের বর্ণবৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের মতোই এক বৈশ্বিক ন্যায়বিচার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।

বিশ্বাস, প্রতিরোধ ও মুক্তির অঙ্গীকার

দখলদাররা ভাবে ধ্বংসযজ্ঞ ফিলিস্তিনিদের মনোবল ভেঙে দেবে। কিন্তু প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘর, প্রতিটি শহীদের রক্ত প্রতিরোধের আগুন আরও জ্বালিয়ে তুলছে। “তারা আমাদের ঘর ভাঙছে, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ধ্বংস করতে পারছে না,” — বলেন তাকরুরি।

এই প্রতিরোধ কোনো রাজনৈতিক লড়াই নয়; এটি ইমান, মর্যাদা ও ন্যায়ের যুদ্ধ। গাজার যোদ্ধারা উম্মাহর সম্মান রক্ষার জন্য লড়ছে, ক্ষমতার জন্য নয়। কোনো আন্তর্জাতিক চাপ তাদের আত্মত্যাগকে নিস্তব্ধ করতে পারবে না।

সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিরোধের উত্তরাধিকার

“আল-আকসা ঝড়”-এর দুই বছর পর ফিলিস্তিনের সংগ্রাম স্থানীয় সীমানা ছাড়িয়ে এক বৈশ্বিক প্রতিরোধ ফ্রন্টে রূপ নিয়েছে। ইয়েমেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, লেবাননে হিজবুল্লাহর সংঘর্ষ, ইরাক-সিরিয়ার প্রতিরোধ, আর জাকার্তা থেকে জোহানেসবার্গ পর্যন্ত সংহতি মিছিল— সবই এক বৃহত্তর মোকাওমাহ ফ্রন্ট”-এর উত্থান নির্দেশ করছে।

আজ ফিলিস্তিন মুসলিম বিশ্বের নৈতিক দিকনির্দেশক; এমন এক প্রতীক, যা নিপীড়িতদের ঐক্যবদ্ধ করে ও দখলদারদের মুখোশ উন্মোচন করে।

নওয়াফ তাকরুরি বলেন— “আল-আকসা ঝড় শুধু একটি সামরিক ঘটনা নয়; এটি এক আদর্শের পুনর্জন্ম, এক জাতির জাগরণ, এবং পুরোনো এক দখলদার ব্যবস্থার অবসানের সূচনা।”

দুই বছর কেটে গেছে, কিন্তু “আল-আকসা ঝড়”-এর প্রতিধ্বনি এখনো বিশ্বের বিবেক ও রাজনীতিতে অনুরণিত। এটি শুধু ফিলিস্তিনের নয়; এটি সকল নিপীড়িত জাতির লড়াই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের আহ্বান।

“তুফান” এখন আর কেবল গাজার নয়— এটি হয়ে উঠেছে এক বিশ্বব্যাপী প্রতীক, যা বলে: অন্যায়ের সামনে নীরবতা সবচেয়ে বড় অপরাধ।”

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button