আল্লাহ শয়তানকে কেন সৃষ্টি করলেন?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: শয়তানের অস্তিত্বের রহস্য : যে প্রশ্ন যুগ যুগ ধরে মানুষের অন্তরে ঝড় তুলেছে যখনই “শয়তান” শব্দটি উচ্চারিত হয়, তখনই একটি প্রাচীন প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে— যদি আল্লাহ পরম দয়াময়, সর্বজ্ঞ ও হেকমতের অধিকারী হন, তবে তিনি কেন এমন এক সত্তাকে সৃষ্টি করলেন যে মানুষকে পথভ্রষ্ট করবে? আল্লাহ কি চান আমরা বিপথগামী হই?
এই প্রশ্নের উপরিতল দেখলে মনে হয় আল্লাহ নিজেই মন্দের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু গভীরে গেলে সত্যটা আলাদা আলোয় উদ্ভাসিত হয়।
আল্লাহ কখনো মন্দ সৃষ্টি করেননি। তিনি কেবল স্বাধীন ইচ্ছা দান করেছেন—যাতে ভালোবাসা স্বেচ্ছায় জন্ম নেয়, আনুগত্য সচেতনভাবে বেছে নেওয়া যায় এবং মানুষের মর্যাদা প্রকাশ পায়।
ইবলিসও একদিন ছিল নির্মল আলোর সারিতে। হাজার হাজার বছর ধরে সে ফেরেশতাদের কাতারে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন ছিল। কিন্তু যখন এলো সিজদার হুকুম, তখন তার অন্তরে অহংকারের কালো ছায়া নেমে এলো। সে নিজেই বেছে নিল অহমিকার পথ। আল্লাহ তাকে পাপী করে সৃষ্টি করেননি; সে নিজের স্বাধীনতা দিয়ে পাপী হয়ে গেল।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়— কেন আল্লাহ মানুষের সামনে ভুলের দরজা খোলা রাখলেন?
কারণ, যদি পৃথিবীতে শুধু একটাই পথ থাকত—শুধু সোজা, নিরাপদ, বাধাহীন ভালো পথ—তাহলে মানুষের কোনো কর্মেই নৈতিক মূল্য থাকত না। যেমনিভাবে অন্ধকার না থাকলে আলোর মহিমা প্রকাশ পায় না, ঠিক তেমনি ভুলের সম্ভাবনা না থাকলে সত্যকে বেছে নেওয়ার সৌন্দর্যও প্রকাশ পেত না।
ইমান তখনই ঝলমল করে, যখন প্রলোভনের ঝড়ের মধ্যেও মানুষ আল্লাহর দড়ি আঁকড়ে থাকে। তাকওয়া তখনই ফুটে ওঠে, যখন গুনাহের ফিসফিসানি কানে এসেও সে পবিত্র থাকতে পারে। ধৈর্য তখনই মহিমান্বিত হয়, যখন পরীক্ষার আগুনে সে নিজেকে পোড়ায় না, বরং পরিশুদ্ধ করে।
শয়তানের উপস্থিতি ধ্বংসের জন্য নয়; সে এসেছে যেন মানুষের স্বাধীনতা পরীক্ষিত হয়, যেন তার অন্তরের সোনা আগুনে জ্বলে আরও উজ্জ্বল হয়। যেমন ক্রীড়াবিদের জন্য ভারই তার শক্তির পরিমাপক, তেমনি শয়তানের প্রলোভনই মানুষের আত্মিক শক্তির মাপকাঠি।
সে কখনো জোর করে পাপ করাতে পারে না। তার অস্ত্র কেবল ফিসফিস, কুমন্ত্রণা, সাজানো স্বপ্ন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক তুমি। তোমার হাতেই চাবি—জান্নাতের দরজা খুলবে, নাকি জাহান্নামের দিকে পা বাড়াবে।
আল্লাহ সব জানেন—কেউ কোন পথ বেছে নেবে। কিন্তু তাঁর এই জ্ঞান তোমার স্বাধীনতাকে গ্রাস করে না। যেমন একজন দূরদর্শী শিক্ষক জানেন, ছাত্র পরীক্ষায় ফেল করবে, তবু সে তাকে জোর করে পাস করিয়ে দেন না—কারণ পাসের মর্যাদা তখনই, যখন নিজে লড়াই করে অর্জন করা হয়।
অতএব শয়তানের অস্তিত্বের রহস্য একটিমাত্র কথায় ধরা পড়ে— আল্লাহ মন্দ সৃষ্টি করেননি, তিনি সৃষ্টি করেছেন স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতার ভেতর দিয়েই মানুষ প্রমাণ করে— সে কেবল মাটির তৈরি দেহ নয়, সে আল্লাহর খলিফা, আলোর উত্তরাধিকারী, যে অন্ধকারের মাঝেও আলো হয়ে জ্বলতে পারে।
যদি প্রলোভন না থাকত, তাকওয়া অর্থহীন হতো। যদি অন্ধকার না থাকত, আলোর জ্যোতি কেউ দেখতে পেত না।
হে মানুষ! তোমার সামনে দুটি পথ— একটি শয়তানের ফিসফিসে ভরা, অন্যটি রহমানের ডাক। বেছে নাও। কারণ এই বেছে নেওয়ার মধ্যেই তোমার মহত্ত্ব, তোমার জান্নাত।



