ধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

আল্লাহ কি একাকিত্ব দূর করার জন্য বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির : মানবজীবনের গভীরে একাকিত্ব এমন এক অনুভূতি, যা প্রায়ই আমাদের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। কিন্তু যখন সেই প্রশ্ন আল্লাহর সত্তায় প্রসারিত হয়—তখন তা দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিকতার এক গভীর অনুসন্ধানে পরিণত হয়।
আল্লাহ, যিনি চিরন্তন, পরিপূর্ণ ও অমুখাপেক্ষী, কি কখনো ‘একাকিত্ব’ অনুভব করেন? আর যদি না করেন, তবে মানুষ, ফেরেশতা ও সমগ্র বিশ্বজগতের সৃষ্টির অন্তর্নিহিত কারণ কী? এই প্রবন্ধে সেই চিরন্তন প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা হয়েছে—যেখানে সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে কোনো অভাব নয়, বরং পরম প্রেমের উদ্ভাস, সূষ্টিকর্তার সৌন্দর্যের প্রকাশ এবং অস্তিত্বের এক অনন্ত আহ্বান।

প্রশ্ন:আমরা বিশ্বাস করি, সকল সুন্দর অনুভূতি আল্লাহর দান, আর নেতিবাচক অনুভূতিগুলো শয়তান ও আমাদের দুর্বলতা থেকে আসে। কিন্তু “একাকিত্বের অনুভূতি” — যা এক ধরনের অস্বস্তিকর ও বেদনাদায়ক অনুভূতি — আল্লাহর মধ্যেও কি থাকতে পারে? অর্থাৎ, সর্বশক্তিমান ও সর্বাপেক্ষা অমুখাপেক্ষী সত্তা কি নিজের একাকিত্বের ভার লাঘব করতে মানুষ ও ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেছিলেন?

উত্তর:প্রথমেই এই বিষয়টি বোঝা জরুরি যে, মানুষ একটি সামাজিক সত্তা; তার কাছে “একাকিত্ব” সাধারণত অপছন্দনীয়। কিন্তু এই ধারণা সব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একজন প্রকৃত ঈমানদার মানুষ, যিনি আল্লাহর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, কখনোই নিঃসঙ্গতার গভীরে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যান না। বরং কখনো কখনো তিনি সেই নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোতেই আত্মিক পরম আনন্দ অনুভব করেন এবং প্রার্থনা করেন যেন এমন একাকিত্বের সময় বারবার ফিরে আসে।

এই বিষয়ে ইমাম সজ্‌জাদ (আঃ) তাঁর এক প্রার্থনায় বলেন —

وَ زَیِّنْ لِیَ التَّفَرُّدَ بِمُنَاجَاتِکَ بِاللَّیْلِ وَ النَّهَار

হে প্রভু! দিন ও রাত্রির নির্জনতায় তোমার সঙ্গে মুনাজাতকে আমার কাছে সুন্দর করে দাও।

একইভাবে ইমাম কাজিম (আঃ) তাঁর প্রিয় শিষ্য হিশাম ইবনে হাকামকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন —
হে হিশাম! নিঃসঙ্গতার ওপর ধৈর্য ধরাই প্রজ্ঞার লক্ষণ। যে ব্যক্তি সত্যিকারে আল্লাহকে চিনেছে, সে দুনিয়াবাজদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, এবং আল্লাহর সান্নিধ্যের প্রতীক্ষায় থাকে। আল্লাহই তার ভয়ভীতির সঙ্গী এবং একাকিত্বে তার সাথি।

দার্শনিক বিশ্লেষণ:

মানবজীবনের দৈনন্দিন বা বস্তুজগতের প্রেক্ষাপটে ‘একাকিত্বের অনুভূতি’ মাঝে মাঝে দেখা দিতে পারে। কিন্তু এই অনুভূতির কোনো স্থান নেই সর্বশক্তিমান, চিরন্তন, পরিপূর্ণ সত্তা — আল্লাহর মধ্যে। কারণ, একাকিত্ব কেবল সেই ব্যক্তির জন্য কষ্টদায়ক, যার মধ্যে ঘাটতি, সীমাবদ্ধতা বা কোনো অভাব আছে। মানুষ নিজের সেই শূন্যতা পূরণ করতে অন্যের সঙ্গ খোঁজে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা — যিনি আদি ও অনন্ত, চিরসমৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ — তাঁর মধ্যে কোনো অভাবের স্থানই নেই। কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে — “اللَّهُ الصَّمَدُ”আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, স্বয়ংসম্পূর্ণ। আরেক স্থানে বলা হয়েছে — “وَهُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ”তিনিই ধনী ও প্রশংসার যোগ্য।অতএব, বলা যায় যে, আল্লাহ মানুষের বা ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেছেন একাকিত্ব দূর করার জন্য নয়। তাঁর সৃষ্টির কোনো কারণই প্রয়োজন বা অভাব পূরণ নয়, কারণ তিনি পরিপূর্ণ ও নির্ভরশীল নন। যদি কোনো উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়, তা কেবলই উচ্চতর লক্ষ্য — যেমন: ইবাদত, জ্ঞানলাভ, বা মহান আল্লাহর করুণার প্রকাশ। অর্থাৎ, সৃষ্টির মূল নিহিত আছে ভালোবাসায় — আল্লাহর আত্মপ্রেম, যা এতই গভীর যে, তা তাঁর সত্তার প্রকাশে রূপ নিয়েছে — সেই প্রকাশই সৃষ্টিজগৎ।

একটি বিখ্যাত হাদিসে (হাদিসে কুদসি) বলা হয়েছে —

کنت کنزا مخفیا فاحببت ان اعرف فخلقت الخلق لاعرف.

অর্থাৎ, আমি ছিলাম এক গোপন ধনভাণ্ডার; আমি চেয়েছিলাম আমাকে জানা হোক, তাই সৃষ্টি করেছি সৃষ্টিজগৎ, যেন তারা আমাকে জানতে পারে।

শেষ কথা: অনেক দার্শনিকের মতে, আল্লাহর সত্তা চিরকালই ক্রিয়াশীল এবং সৃজনশীল। তাই এমন কোনো সময় কল্পনা করা যায় না, যখন তাঁর কোনো সৃষ্টি ছিল না। অর্থাৎ, আল্লাহ সবসময় ‘একাকী’ — সত্তার স্তরে তিনি একক ও তুলনাহীন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি সবসময় ‘সঙ্গী’ও বটে — কর্মের স্তরে তিনি সর্বদা উপস্থিত, সক্রিয় এবং সৃষ্টির প্রতিটি ক্ষণে জড়িত। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে — “کلَّ یَوْمٍ هُوَ فِی شَأْنٍ” — প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, তিনি নতুন কর্মে নিয়োজিত।

সূত্র: কুরআনে কারিম

১. ইমাম সজ্জাদ (আ.) — সাহিফা সাজ্জাদিয়া, পৃষ্ঠা ২২৬।

২. শেখ কুলাইনি — আল-কাফি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭।

৩. হাফেজ বরসি — মাশারিক আনওয়ার আল-ইয়াকিন, পৃষ্ঠা ৪১

৪. «মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য» — ইসলাম কোয়েস্ট ।

আরও পড়ন

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button