আল্লাহর ভয় : অর্থ, প্রয়োজনীয়তা ও মানবজীবনে এর নৈতিক প্রভাব
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ তাকী মিসবাহ ইয়াযদি (রহ.)-এর ব্যাখ্যার আলোকে ইসলামী নৈতিকতার গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, “ভয়” কোনো স্বতন্ত্রভাবে ভালো বা মন্দ নয়; এর মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার উদ্দেশ্য, ফলাফল ও লক্ষ্যবস্তুর ওপর ভিত্তি করে। আয়াতুল্লাহ মিসবাহ ইয়াযদি (রহ.) অতি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—আল্লাহকে ভয় করা মানে তাঁকে “ভয়ংকর” মনে করা নয়; বরং নিজের প্রতিটি কর্মের অনিবার্য পরিণতি সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকা। কেননা, প্রতিটি কারণ-কার্য, প্রতিটি অনুগ্রহ ও প্রতিটি শাস্তির চূড়ান্ত মালিক একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা। সুতরাং এই আল্লাহর-সচেতন ভয়ই মানুষের অন্তরকে পাপের অন্ধকার থেকে আলোর পথে টেনে নিয়ে যায় এবং আত্মাকে শুদ্ধতার শিখরে পৌঁছে দেয়।
আল্লাহ–ভীতির প্রকৃত অর্থ
মানুষ সাধারণত ভয় পায় এমন কিছুকে, যা তার ক্ষতি করতে পারে, প্রিয়জনকে কেড়ে নিতে পারে কিংবা বিপদ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তো অসীম দয়া, করুণা ও মেহেরবানির অফুরন্ত ঝরনা—তাহলে তাঁকেই বা কেন ভয় করতে হবে?
প্রকৃত কথা এই যে, মানুষ ভয় করে ক্ষতিকে, আর ক্ষতির কারণকেও ভয় করে। ইসলামী দর্শনে সব দৃশ্যমান কারণের আড়ালে একমাত্র প্রকৃত কারণ হলেন আল্লাহ। তাই যথার্থ ভয় কেবল তাঁরই প্রাপ্য।
যেমন বীজের অঙ্কুরোদগম হয় বৃষ্টি ও মাটির রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়—কিন্তু কুরআন আমাদের শেখায় যে, এই সমস্ত প্রক্রিয়ার প্রকৃত “ফালিক” বা বিভাজক একমাত্র আল্লাহ: ﴿إِنَّ اللَّهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَىٰ﴾ “নিশ্চয়ই আল্লাহই দানা ও আঁটির বিভাজক।” (সূরা আল-আন‘আম ৬:৯৫)
অতএব, সৃষ্টিজগতের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মূল নিয়ন্ত্রক আল্লাহ। সুতরাং প্রকৃত ভয়ও তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি হওয়া উচিত।
পাপ, শাস্তি ও আল্লাহ–ভীতি
যখন মানুষ আল্লাহকে ভয় করে, সে আসলে আল্লাহর শরী‘আতের আলোকে নিজের কৃত পাপের ভয়ংকর পরিণামকে ভয় করে। পাপ মানুষকে আল্লাহর রহমতের ছায়া থেকে দূরে সরিয়ে নরকের অগ্নিকুণ্ডের দিকে ঠেলে দেয়।
আল্লাহ বলেন: ﴿ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ﴾ “মানুষের হাতের উপার্জনের কারণে স্থলে ও সমুদ্রে ফ্যাসাদ প্রকাশ পেয়েছে, যাতে আল্লাহ তাদের কিছু কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করান—যেন তারা ফিরে আসে।” (সূরা আর-রূম ৩০:৪১)
আর যদি আল্লাহ প্রতিটি পাপের শাস্তি তাৎক্ষণিক দিতেন, তবে: ﴿وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِمَا كَسَبُوا مَا تَرَكَ عَلَىٰ ظَهْرِهَا مِنْ دَابَّةٍ﴾ “পৃথিবীর পিঠে একটি প্রাণীও অবশিষ্ট থাকত না।” (সূরা ফাতির ৩৫:৪৫)
কেন ইসলাম আল্লাহ–ভীতির শিক্ষা দেয়?
১. ভয় নিজে নিন্দনীয় নয় ভয় একটি স্বাভাবিক মানসিক প্রতিক্রিয়া। এর মূল্য নির্ভর করে এটি মানুষকে কোন পথে নিয়ে যায়। যদি ভয় সতর্কতা, সংশোধন ও কল্যাণের পথে নিয়ে যায়, তবে তা প্রশংসনীয়। আল্লাহ-ভীতি ঠিক এই শ্রেণীর ভয়—যা অন্তরকে জাগ্রত রাখে।
২. আল্লাহই সর্বোত্তম শিক্ষক কুরআনে নবীদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে “বশীর” (সুসংবাদদাতা) ও “নযীর” (সতর্ককারী) হিসেবে। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়, “নযীর” শব্দটিকে সর্বজনীন করা হয়েছে: ﴿وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ﴾ “প্রতিটি উম্মতের মধ্য দিয়েই একজন সতর্ককারী গত হয়েছে।” (সূরা ফাতির ৩৫:২৪) কারণ মানব-মনোজগতে ভয়ই দ্রুততম ও কার্যকর প্রেরণা।
৩. মনোবিজ্ঞানের সাক্ষ্য অভিজ্ঞতা ও গবেষণা বলে, মানুষের আচরণের প্রায় ৯০% ক্ষেত্রে ভয়ই প্রধান চালিকাশক্তি। ছাত্র পড়ে—ফেল করার ভয়ে। চালক সিগন্যাল মানে—জরিমানা ও দুর্ঘটনার ভয়ে। মুমিন নামায পড়ে—আখিরাতের হিসাবের ভয়ে। যদিও কিছু উচ্চমনা ব্যক্তি শুধুই ভালোবাসা ও জ্ঞানের তাড়নায় চলে, তবু সাধারণ মানুষের জন্য ভয়ই সবচেয়ে শক্তিশালী শিক্ষক।
খোদা–ভীতির সর্বোচ্চ স্তর
আধ্যাত্মিক পথের প্রাথমিক সোপানে মানুষ জাহান্নামের আগুনকে ভয় করে। কিন্তু যখন সে আল্লাহর প্রেমে ডুবে যায়, তখন তার ভয়ের স্তর পাল্টে যায়। সেখানে আর শাস্তির ভয় থাকে না; থাকে শুধু একটি ভয়— “আল্লাহ আমার দিকে তাকাবেন না, আমার সঙ্গে কথা বলবেন না, আমাকে পবিত্র করবেন না।”
কুরআন এই ভয়ংকরতম শাস্তির কথা বলে: ﴿وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না—এবং তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা আলে ইমরান ৩:৭৭)
যে হৃদয় একবার আল্লাহর সান্নিধ্যের স্বাদ পেয়েছে, তার কাছে এই ঐশী বিমুখতা জাহান্নামের আগুনের চেয়েও ভয়ংকর। যেমন শিশুর কাছে মায়ের রাগ জিঘাংসার চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক, যেমন প্রেমিকের কাছে প্রিয়ার বিচ্ছেদ মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ— তেমনি আশেকে ইলাহীর কাছে আল্লাহর দৃষ্টি হারানোই সর্বোচ্চ ভীতি।
উপসংহার
আল্লাহ-ভীতি কোনো অন্ধকারময় নেতিবাচক মনোভাব নয়; বরং এ হলো আত্মার জাগরণের আলো, দায়িত্ববোধের উৎস এবং নৈতিকতার সুরক্ষাকবচ। সাধারণ মানুষের জন্য এটি শাস্তির ভয় থেকে পাপমুক্তির হাতিয়ার, আর আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত মুমিনের জন্য এটি প্রিয়তমের সান্নিধ্য হারানোর গভীর উৎকণ্ঠা।
এই ভয়ই মানুষকে পাপের গর্ত থেকে টেনে উঠিয়ে ফেরেশতাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড় করায়—যেখানে সে আর শুধু ভয় করে না, বরং ভালোবাসার সাগরে ডুবে গিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির একটি মুহূর্তকে সমস্ত জাহানের চেয়ে অধিক মূল্যবান মনে করে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই উচ্চমার্গের তাকওয়া দান করুন, যে তাকওয়া শাস্তির ভয় থেকে শুরু হয়ে তাঁর প্রেমে পূর্ণতা লাভ করে। আমীন।
সূত্র : আয়াতুল্লাহ মিসবাহ ইয়াযদীর রচনাসমগ্র তথ্যভাণ্ডার।



