কুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

আল্লাহর নির্ধারিত মাপকাঠি—মানবতার সৌন্দর্য ও সত্যের মানদণ্ড

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া ‍মিহির: আধুনিক বিশ্বে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ বা মানদণ্ড বলতে আমরা বুঝি প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, বিচার কিংবা সেবার ক্ষেত্রে গুণগত মান ও ন্যায্যতার নির্ধারিত কাঠামো। কিন্তু কোরআনের ভাষায় এই ধারণা শুধু একটি নিয়ম নয়, বরং এটি আল্লাহর সৃষ্টি-ব্যবস্থার শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের প্রতিফলন—যার নাম ‘মিজান’। এটি এমন এক ঐশী পরিমাপক, যা মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে ভারসাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তি গড়ে তোলে।

 কোরআনের আলোকে ‘মানদণ্ড’ ঐশী শৃঙ্খলার ধারাবাহিকতা

কোরআনের আয়াত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমরা আজ যে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ বা মানদণ্ডের ধারণা ব্যবহার করি, তা আসলে আল্লাহর সৃষ্টি-ব্যবস্থায় প্রচলিত ‘মিজান’ (পরিমাপ) ও ‘কিস্ত’ (ন্যায়বিচার)-এরই ধারাবাহিকতা। অন্যভাবে বললে, কোরআনের দৃষ্টিতে মানদণ্ড মানে—মানুষের জীবনযাত্রাকে আল্লাহপ্রদত্ত সৃষ্টিজগতের ভারসাম্য ও শৃঙ্খলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা।

স্ট্যান্ডার্ড: শুধু প্রযুক্তি নয়, এক দৃষ্টিভঙ্গি

আজকের দিনে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ শব্দটি সাধারণত শিল্প, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা বিচারব্যবস্থায় গুণগত মান ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার নিয়ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর গভীরে রয়েছে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থান—একটি বিশ্বদৃষ্টি।

এই বিশ্বাসে নিহিত আছে যে, বিশ্বজগতের প্রতিটি সৃষ্টির নির্দিষ্ট পরিমাপ, ভারসাম্য ও অনুপাত রয়েছে। মানুষকেও তার আচরণ, উৎপাদন, বিচার ও সিদ্ধান্তে সেই নির্ধারিত ও ন্যায্য মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে।

মিজান, ‘কদর’ কিস্ত’—কোরআনের ভাষায় মানদণ্ড

কোরআনে এই শৃঙ্খলা-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি শুধু প্রকৃতি বা মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেই নয়, বরং মানবিক ও সামাজিক আচরণেও বারবার উঠে এসেছে।

‘মিজান’ (পরিমাপক), ‘কদর’ (নির্ধারিত পরিমাণ), ‘কিস্ত’ (ন্যায়বিচার), ‘আদল’ (সমতা), ‘তাওফিয়াহ’ (পূর্ণমাত্রায় প্রদান)—এই শব্দগুলো কোরআনের সেই ঐশী কাঠামোর ইঙ্গিত দেয়, যা মানবজীবন ও সমাজকে একটি ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চায়।

অর্থাৎ, আধুনিক শব্দ ‘স্ট্যান্ডার্ড’ কোরআনে সরাসরি না থাকলেও, তার মূল দর্শন ও নৈতিক ভিত্তি কোরআনের বহু আয়াতে বিদ্যমান।

সৃষ্টির শৃঙ্খলাই মানদণ্ডের ভিত্তি

কোরআনের দৃষ্টিতে পুরো বিশ্বজগত একটি নিখুঁত পরিমাপ ও শৃঙ্খলার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন আল্লাহ বলেন:

“আল্লাহ প্রতিটি বস্তুর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাপ রেখেছেন।” (সূরা ত্বালাক, আয়াত ৩)

তাফসীরকার আল্লামা তাবাতাবায়ী ‘কদর’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন—প্রতিটি সৃষ্টির অস্তিত্ব ও কার্যকারিতার সীমা পূর্বনির্ধারিত। এখান থেকেই বোঝা যায়, মহাবিশ্বের স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যের মূল ভিত্তি হল ঐশী স্ট্যান্ডার্ড।

আরেক আয়াতে বলা হয়েছে:

“আমি পৃথিবীতে প্রত্যেক কিছুকে সমন্বিত পরিমাপের অধীন করে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা হিজর, আয়াত ১৯)

এখানে “মাওযূন” শব্দটি বোঝায়—যা ওজন ও অনুপাত অনুযায়ী সুচিন্তিতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ। অর্থাৎ, সৃষ্টিজগতের কিছুই এলোমেলো বা উদ্দেশ্যহীন নয়।

মানবজীবনে মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা: আল্লাহর শৃঙ্খলার অনুসরণ

কোরআনের আলোকে বলা যায়, মানুষ যখন ব্যবসা, বিচার, স্থাপত্য, উৎপাদন বা রাষ্ট্র পরিচালনায় শৃঙ্খলা ও নির্ভুলতা অনুসরণ করে, তখন সে আল্লাহর সৃষ্টি-ব্যবস্থারই অনুকরণ করছে।

যেমন আল্লাহ বিশ্বজগতকে ‘মিজান’ ও ‘কিস্ত’-এর ভিত্তিতে গড়েছেন, তেমনি মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনেও পরিমিতি, ন্যায্যতা ও নির্ধারিত মান বজায় রাখা জরুরি।

মিজান: ন্যায়বিচারের প্রতীক সর্বজনীন মানদণ্ড

 কোরআনের ঘোষণা: মিজানের গুরুত্ব

আল্লাহ বলেন:

وَالسَّمَاءَ رَفَعَهَا وَوَضَعَ الْمِيزَانَ ۝ أَلَّا تَطْغَوْا فِي الْمِيزَانِ ۝ وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ তিনি আকাশকে সুউচ্চে স্থাপন করেছেন এবং স্থির করেছেন মিজান (পরিমাপক) যাতে তোমরা পরিমাপে সীমালঙ্ঘন না করো। ন্যায়ের সঙ্গে ওজন করো এবং কম দিও না।সূরা আররহমান, আয়াত

এই আয়াতগুলো শুধু একটি ধর্মীয় নির্দেশ নয়, বরং মানবজাতির জন্য এক চিরন্তন বার্তান্যায়, ভারসাম্য শৃঙ্খলার ভিত্তিতে জীবন গড়ার আহ্বান।

 মিজান: যন্ত্র নয়, দর্শন

মুফাসসিরগণ ব্যাখ্যা করেছেন, ‘মিজান’ একদিকে দাঁড়িপাল্লার মতো পরিমাপক যন্ত্র, অন্যদিকে এটি একটি ঐশী নীতিমালা—যা সৃষ্টিজগত ও মানবজীবনের জন্য নির্ধারিত মানদণ্ড।

প্রতীকী অর্থে, মিজান হলো সেই চূড়ান্ত পরিমাপক কাঠামো, যার সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করতে হয়—মানব আচরণ, সামাজিক নীতি কিংবা কোনো বস্তুর গুণগত মান।

 স্ট্যান্ডার্ড: আধুনিক ভাষায় ঐশী শৃঙ্খলা

আজকের দুনিয়ায় ‘স্ট্যান্ডার্ড’ বলতে আমরা বুঝি—শিল্প, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, বিচারব্যবস্থা কিংবা সেবার ক্ষেত্রে গুণগত মান ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার নিয়ম। কিন্তু কোরআনের ভাষায় এই স্ট্যান্ডার্ডের ভিত্তি হলো মিজান—যা আল্লাহর সৃষ্টি-ব্যবস্থার শৃঙ্খলা ও ভারসাম্যের প্রতিফলন।

যেমন দাঁড়িপাল্লা ছাড়া সঠিক ওজন নেওয়া যায় না, তেমনি সত্য ও ন্যায়ের মিজান ছাড়া চিন্তা, বিচার বা রাষ্ট্রব্যবস্থা সঠিক হতে পারে না।

 তত্বফিফ: স্ট্যান্ডার্ড ভঙ্গের চিত্র

আল্লাহ বলেন:

وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِينَ ۝ الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ ۝ وَإِذَا كَالُوهُمْ أَو وَّزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ “ধ্বংস তাদের জন্য, যারা পরিমাপে প্রতারণা করে— যারা নিজেরা গ্রহণ করলে পূর্ণ পরিমাণ নেয়, কিন্তু অন্যকে দিলে কম মেপে দেয়।” — সূরা মুত্তাফিফীন, আয়াত ১–৩

তাফসীরকারদের মতে, ‘তত্বফিফ’ মানে শুধু কম মাপা নয়—এর মধ্যে আছে গুণমান কমিয়ে দেওয়া, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, তথ্য বিকৃতি, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। এইসব আচরণ শুধু পাপ নয়, বরং সমাজের আস্থার ভিত্তি ধ্বংস করে।

নবীদের মিশনে মিজানের গুরুত্ব

আল্লাহ বলেন:

لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ “আমরা আমাদের রাসূলগণকে স্পষ্ট নিদর্শনসহ পাঠিয়েছি, এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও মিজান— যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।” — সূরা হাদীদ, আয়াত ২৫

এখানে ‘কিতাব’ মানে জ্ঞান ও দিশা, আর ‘মিজান’ মানে ন্যায়ের পরিমাপক কাঠামো। এই দুইয়ের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ।

উপসংহার: মিজান মানেই মানবতার মানদণ্ড কোরআনের দৃষ্টিতে স্ট্যান্ডার্ড কোনো মানব-নির্মিত চুক্তি নয়; এটি আল্লাহর সৃষ্টি-শৃঙ্খলারই প্রতিফলন। সৃষ্টিজগতের মিজান যেমন অবিচল, তেমনি মানবসমাজেও মিজান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড মানা মানে কেবল নিয়ম পালন নয়— এটি ঈমানের দাবি, নবীদের মিশনের ধারাবাহিকতা।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button